Main Slogan:

হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর (সূরা বাকারা : ২০৮)

বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১০

ঘুষ ও দুর্নীতি দমনে মহানবী (স.) প্রণীত পদক্ষেপসমূহ



ঘুষ ও দুর্নীতি দমনে মহানবী (স.) প্রণীত পদক্ষেপসমূহ

তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করোনা এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে শুনে অন্যায় পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসনকর্তা বা বিচারকদের হাতে উৎকোচ (ঘুষ) তুলে দিওনা (সুরা বাকারা-১৮৮ আয়াত)। আলস্নাহ্ রাব্বুল আলামীন এখানে ঘুষের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এবং বিচারকদের হাতে ঘুষ দিয়ে রায় নিজের পক্ষে নিতেও বারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিষয়টি যেন হালাল হিসেবে পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। কারণ সরকারী-বেসরকারী প্রায় সকল অফিসেই ঘুষের বিনিময়েই বেশির ভাগ কাজ সুরাহা করা হয়। ঘুষের অংক যত বেশি হয় ফাইল ততো দ্রুতগতিতে দেঁৗড়াতে শুরু করে। আর ঘুষ ছাড়া কোন ফাইলই যেন নড়াচড়া করে না। সমাজের অসহায় এবং ক্ষমতাহীন মানুষেরা তাদের হূত অধিকার কিংবা অন্যের অধিকারকে করায়ত্ব করার লক্ষ্যে ধূর্ত দুনর্ীতিপরায়ণ কর্তা বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে অবৈধ অর্থ কিংবা পণ্যসামগ্রী পর্দার অন্তরালে প্রদান করে স্বার্থ হাছিল করার নিমিত্তে উৎকোচ প্রদান করে থাকে। যা মানব বিধ্বংসী গুরুতর অপরাধ। এর মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বান্দার হক বা অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়। যে অপরাধ ক্ষমা করা না করার বিষয়টি স্বয়ং আলস্নাহতায়ালা বান্দার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। বান্দা ক্ষমা না করলে আলস্নাহতায়ালা এই অপরাধ কখনোই ক্ষমা করবেন না।

ঘুষ গ্রহণ করা নিন্দনীয় ও গুনাহের কাজ বলে রসুল (সঃ) তার হাদীসেও উলেস্নখ করেছেন। হযরত আব্দুলস্নাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত রসুল (সঃ) বলেন, ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামে যাবে (তাবারাণী)। হযরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত অন্য হাদীসে আছে যে ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়কেই রসুল (সঃ) লানত করেছেন (আবু দাউদ)। হযরত ছাওবান (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রসুল (সঃ) ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা এবং ঘুষের দালাল সকলের উপর লানত করেছেন (আহমদ তাবারাণী)। এই পৃথিবীতে মান-মর্যাদা ও সম্মান-প্রতিপত্তির অধিকারী হওয়ার মাঝেই সার্থকতা রয়েছে। বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্য-এর তুলনায় মানুষ মান-সম্মান অর্জনের জন্যই দেদারছে সম্পদ ব্যয় করে। অন্য বিষয়ে ব্যয়ের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই খাতে তার ব্যয়ের সীমা পরিসীমা থাকে না। সম্পদের একটা উলেস্নখযোগ্য অংশ মানুষ তার মান-সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের পিছনে ব্যয় করে থাকে। মানব জীবনের প্রকৃত সার্থকতা হলো মান-মর্যাদা অর্জন।

আর এর মোকাবেলায় অর্থ-বিত্ত একেবারেই মূল্যহীন বস্তু। তাই যখন কেউ ঘুষ গ্রহণ করে তখন তার মানসম্মান ধুলোয় মিশে যায়। ঘুষ গ্রহীতা দুর্নীতিবাজগণ গভীরভাবে ভেবে দেখুন যে, এটা আপনাদের আত্মমর্যাদা বিনাশের এক বিরাট আত্মঘাতী পদক্ষেপ এবং বংশ মর্যাদার জন্য এক অশুভ লক্ষণ। আলস্নাহ্র ভয়ে মানুষ যে কোন ধরনের অন্যায় কাজ হতে দূরে থাকে। কিন্তু ঘুষ-মানুষের অন্তর থেকে আলস্নাহ্ভীতি দূর করে দেয়। ঘুষের কারণে মানবিক আচরণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুহূর্তেই মানুষ অমানুষে পরিণত হয়। পরম সহিষ্ণুতার, অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, লজ্জাশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, অন্যায় প্রতিরোধের স্পৃহা এবং আত্মসম্মানবোধের মতো মানবিক সুকুমার বৃত্তিগুলি ঘুষের প্রভাবে মানুষ হারিয়ে ফেলে। ঘুষ কুরআন হাদীস স্বীকৃত নিষিদ্ধ বিষয়। সুরা বাকারার ১৬৮ আয়াতে আলস্নাহ তায়ালা বলেন, হে মানবজাতি। জমিনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তা থেকে তোমরা হালাল ও পবিত্র বস্তুসমূহ খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা, কেন না সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। অনুরূপভাবে সুরা নাহলে বলা হয়েছে তোমাদেরকে আলস্নাহ তায়ালা যে পবিত্র ও হালাল রুজি দান করেছেন তা থেকে তোমরা খাও এবং আলস্নাহর নেয়ামতসমূহের শুকরিয়া আদায় করো, যদি তোমরা তাঁরই উপাসক হয়ে থাকো। পৃথিবীতে জীবন পরিচালনা করতে অর্থের প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতা সম্পর্কে যেমন সবাই একমত, তেমনি অর্থ-সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রেও ভাল ও মন্দ তথা বৈধ-অবৈধ দু'টি ব্যবস্থার ব্যাপারেও দুনিয়ার সবাই একমত। দুনিয়ার সবাই মন্দ বলে মনে করে থাকে চুরি, ডাকাতি, ধোকা, ঘুষ, জুয়া প্রভৃতি কাজকে। এই পন্থাগুলোর মধ্যে বৈধ ও অবৈধ নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে নেই। এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করেছেন স্বয়ং আলস্নাহতায়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যা দেশ-কাল ও গোত্র গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্য এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মূলতঃ ঘুষ হারাম করার পিছনে কারণ হলো এই যে, এতে জনসাধারণের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে। এর ফলে কতিপয় ব্যক্তি ফুলে ফেপে বড় লোক বনে যায় আর বৃহত্তর অংশ দারিদ্র্য কবলিত হয়ে পড়ে। ঘুষ চার প্রকার (১) ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য নেতৃত্ব ও পদবী লাভের জন্য, নিজের সপক্ষে রায় দেয়ার জন্য উচ্চ পর্যায়ের বা নিম্ন পর্যায়ের লোকদেরকে যা দেয়া হয় তা ঘুষ (২) ন্যায়কে অন্যায় ও অন্যায়কে ন্যায় বানানোর জন্যে যা ব্যয় করা হয় তাও ঘুষ। উক্ত দুই প্রকারের ঘুষদাতা, ঘুষখোর ও ঘুষের দালাল রসুল (সঃ) এর হাদীস অনুযায়ী অভিশাপ প্রাপ্ত ও জাহান্নামী (৩) নিজের প্রকৃত হক উদ্ধারের জন্য কর্মকর্তা বা তার নিকট সুপারিশকারীকে কিছু দেয়া। (৪) কোন অত্যাচারী জালিম ব্যক্তি হতে বা তার জুলুম থেকে নিজের এবং পরিবার পরিজনের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষার সম্ভব হচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় ঘুষ দেয়ার বিষয়ে কিছুটা অবকাশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রহীতার ক্ষেত্রে সকল অবস্থায় ঘুষ নেয়া হারাম এবং হাদীসের ভাষায় সে অভিষপ্ত ও জাহান্নামী। হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত। রসুল (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কারো জন্য কোনো সুপারিশ করলো আর এজন্য সুপারিশ প্রাপ্ত ব্যক্তি তাকে কোনো হাদিয়া দিল এবং সে তা গ্রহণ করলো তবে নিঃসন্দেহে সে ঘুষের দরজাসমূহের মধ্য হতে একটি বড় দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো (আবু দাউদ) আমাদের সমাজে যারা পৈত্রিক সূত্রে মুসলমান তারা এ সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে না। যার ফলে এ সমস্ত অন্যায়গুলো সমাজ জীবন হতে নিমর্ূল হয় না। রসুল (সঃ) এর অন্য একটি হাদীসে আরো পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য কি কারণে সৃষ্টি হয় হযরত আমর ইবনে আস (রা.) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি রসুল (সঃ) কে বলতে শুনেছি, যে সমাজে যেনা-ব্যভিচার সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে অথচ এর কোন বিচার হয় না। সেই সমাজ দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত না হয়ে পারে না। আর যে সমাজে ঘুষের কারবার ছড়িয়ে পড়ে সে সমাজে ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি না হয়ে পারে না (মুসনাদে আহমদ) এই হাদীস থেকে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ও মূল উৎস কোথায় তা জানা সহজ হলো।

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে কোন কাজ উদ্ধার করার জন্য যা কিছু দেয়া হয় তা সবই ঘুষের পর্যায়ে পড়ে। যেমন হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুল (সঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কাউকে ঋণ দেয় আর ঋণ গ্রহীতা যদি তাকে কোন হাদীয়া দেয় কিংবা তার যানবাহনে বিনা ভাড়ায় চড়তে বলে তখন যেন সে তার হাদিয়া বা উপটৌকন গ্রহণ না করে এবং বিনা ভাড়ায় তার যানবাহনেও না চড়ে। অবশ্য পূর্ব থেকেই যদি তাদের উভয়ের মধ্যে এরূপ লেন-দেনের ধারা চলে আসে তবে তা ভিন্ন কথা (ইবনে মাজাহ) সুতরাং যারা মুসলিম বলে দাবি করেন ও ইসলামী অনুশাসনে নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজাতে চায় তারা অবশ্যই এ সমস্ত সামান্য ব্যাপারেও সতকর্তা অবলম্বন করবে। তা নাহলে সব আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে ও তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। আলস্নাহ্র রসুল (সঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন, "আর রাশি অল মুরতাশি কিলাহুমা ফিন নার" ঘুষ দাতা, ঘুষ গ্রহীতা এবং ঘুষের লেনদেনে সহযোগিতাকারীগণ সকলেই অভিষপ্ত ও জাহান্নামী।

আমাদের বুঝতে হবে যে, পৃথিবীর জীবন আসল জীবন নয়। এটি একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র। প্রকৃত জীবন হলো পরকালের জীবন। যে জীবনের কোনো শেষ নেই। সেই জীবনে সুখী হওয়াই প্রকৃত সুখ। নশ্বর এই দুনিয়ায় সামান্য কয়টা দিন সুখী হওয়ার জন্য লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিতে জড়ালে তা হবে নিজেই নিজেকে ধ্বংসস্তুপে নিক্ষেপের নামান্তর। আমাদের মধ্যে যারা এ সমস্ত কাজে জড়িত তাদের সকলকে এই পাপের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে সত্য-ন্যায়ের পথে হালাল জীবিকা নির্বাহ করে জীবন-যাপন করার তাওফিক আলস্নাহ্তায়ালা দান করুন, আমীন।

-মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Relaeted Other Islamic Blog

Other Blog-site: