সদাকাতুল ফিতর সংক্রান্ত জরুরী মাসায়িল
- মুফতী ইহতিশামুল হক নোমান
প্রয়োজনে: ০১৭১৪৬১৯১৬০
প্রয়োজনে: ০১৭১৪৬১৯১৬০
যাদের উপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব
ক্স ঈদুল ফিতরের দিন সোবহে সাদেকের সময় যার নিকট যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ/ সম্পদ থাকে তার উপর সদকায়ে ফিতর বা ফেতরা ওয়াজিব। তবে যাকাতের নেসাবের েেত্র ঘরের আসবাবপত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয় না; কিন্তু ফেতরার েেত্র অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র সৌখিন দ্রব্যাদি, খালিঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর তার জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এসব কিছুর মূল্য হিসেবে ধরা হবে।
ক্স রোযা না রাখলে বা রাখতে না পারলে তার উপর ফেতরা দেয়া ওয়াজিব।
ক্স সদকায়ে ফিতর / ফিতরা নিজের প থেকে এবং পিতা হলে নিজের না-বালেগ সন্তানের প থেকে দেয়া ওয়াজিব। বালেগ সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, চাকর-চাকরানী, মাতা-পিতা প্রমুখের প থেকে দেয়া ওয়াজিব নয়। তবে বালেগ সন্তান পাগল হলে তার প থেকে দেয়া পিতার উপর ওয়াজিব।
ক্স একান্নভুক্ত পরিবার হলে বালেগ সন্তান, মাতা, পিতার প থেকে এবং স্ত্রীর প থেকে ফেতরা দেয়া মুস্তাহাব- ওয়াজিব নয়। (বেহেশতী যেওর [বাংলা])
ক্স সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব না হলেও সঙ্গতি থাকলে দেয়া মুস্তাহাব এবং অনেক সওয়াবের কাজ। (ঐ)
সদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ ঃ
ক্স ফিতরায় ৮০ তেলার সেরের হিসেবে ১ সের সাড়ে বার ছটাক (১ কেজি ৬৬২ গ্রাম) গম বা আটা কিংবা তার মূল্য দিতে হবে। পূর্ণ দুই সের (১ কেজি ৮৬৬ গ্রাম) বা তার মূল্য দেয়া উত্তম।
ক্স ফিতরায় যব দিলে ৮০ তোলার সেরের হিসেবে ৩ সের নয় ছটাক (প্রায় ৩ কেজি ৫২৩ গ্রাম) দিতে হবে। পূর্ণ ৪ সের (৩ কেজি ৭৩২ গ্রাম) দেয়া উত্তম।
ক্স গম, আটা ও যব ব্যতীত অন্যান্য খাদ্য শষ্য যেমন ধান, চাউল, বুট, কলাই, মটর ইত্যাদি দ্বারা ফেতরা আদায় করতে চাইলে বাজার দরে উপরোক্ত পরিমাণ গম বা যবের যে মূল্য হয় সেই মূল্যের ধান চাউল ইত্যাদি দিতে হবে।
ক্স ফিতরায় গম, যব ইত্যাদি শষ্য দেয়ার চেয়ে তার মূল্য- নগদ টাকা-পয়সা দেয়া উত্তম।
সদাকাতুল ফিতর কখন আদায় করবে
ক্স ফিতরা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উত্তম। নামাযের পূর্বে দিতে না পারলে পরে দিলেও চলবে। ঈদের দিনের পূর্বে রমযানের মধ্যে দিয়ে দেয়াও দুরস্ত আছে।
সদাকাতুল ফিতর কাকে দিবে ঃ
ক্স যাকে যাকাত দেয়া যায় তাকে ফেতরা দেয়া যায়।
ক্স একজনের ফেতরা একজনকে দেয়া বা একজনের ফেতরা কয়েকজনকে দেয়া উভয়ই দুরস্ত আছে। কয়েক জনের ফেতরাও একজনকে দেয়া দুরস্ত আছে; কিন্তু তার দ্বারা যেন সে মালিকে নেসাব না হয়ে যায়। অধিকতর উত্তম হল একজনকে এই পরিমাণ ফেতরা দেয়া, যার দ্বারা সে ছোট-খাট প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বা পরিবার পরিজন নিয়ে দু’তিন বেলা খেতে পারে। (মাও: হেমায়েতুদ্দীনকৃত আহকামে যিন্দেগী: ২৩২-২৩৩)
সদাকাতুল ফিতর আদায় সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা ঃ
সদকায়ে ফিতর সম্পর্কিত হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও গম। এ পাঁচ প্রকারের মধ্যে যব, খেজুর, পনিরও কিসমিস দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করতে চাইলে প্রত্যেকের জন্য এক সা’ দিতে হবে। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আঁধা সা’ দিতে হবে। এটা হল ওজনের দিক দিয়ে তফাত। আর মূল্যের দিক থেকে তো পার্থক্য রয়েছেই। যেমন-
(ক) আজওয়া (উন্নতমানের) খেজুরের মূল্য প্রতি কেজি ১০০০/- টাকা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৩২৫৬/- (তিন হাজার দুইশত ছাপান্ন) টাকা।
(খ) মধ্যম ধরনের খেজুর যার মূল্য প্রতি কেজি ৩০০/- টাকা হারে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৯৭৭/- (নয়শত সাতাত্তর) টাকা।
(গ) কিসমিস প্রতি কেজি ২৩০/- টাকা করে হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৭৪৮/- (সাতশত আটচলিশ) টাকা।
(ঘ) পনির প্রতি কেজি ৫০০/- (পাঁচশত) টাকা করে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ১৬২৮/- (এক হাজার ছয়শত আটাশ) টাকা।
(ঙ) গম প্রতি কেজি ৩৫/- টাকা হিসেবে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতরা দাঁড়ায় ৫৭/- টাকা।
হাদীসে এ ৫টি দ্রব্যের যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যে কোনো ১টি দ্বারা তা আদায় করতে পারে। এখন ল্যণীয় বিষয় হল, সকল শ্রেণীর লোক যদি সবচেয়ে নিম্ন মূল্য-মানের দ্রব্য দিয়েই নিয়মিত সদকা আদায় করে তবে হাদীসে বর্ণিত অন্য চারটি দ্রব্যের হিসেবে ফিতরা আদায়ের উপর আমল করবে কে? আসলে এেেত্র হওয়া উচিত ছিল এমন যে, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সদকা ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসাবে দেওয়ার সে তাই দিবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারে। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিউ উত্তম নিয়ম। এ নিয়মই ছিল নবী, সাহাব, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের স্বর্ণযুগে। এ পর্যন্ত কোথাও দুর্বল সূত্রে একটি প্রমাণ মেলেনি যে, স্বর্ণযুগের কোনো সময়ে সব শ্রেণীর সম্পদশালী সর্বনিম্ন মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করেছেন। এখানে এ সংক্রান্ত কিছু বরাত পেশ করা হচ্ছে।
হাদীস
নবী কারীম সালালাহু আলাইহি ওয়া সালামকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন-
‘দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’- সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইতাক ৩/১৮৮; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান বাব আফযালুল আমল ১/৬৯।
সাহাবায়ে কিরাম এর আমল
(ক) হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,
‘আমরা সদকা ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খাদ্য দ্বারা অথবা এক ‘সা’ যব অথবা এক ‘সা’ খেজুর কিংবা এক ‘সা’ পনির বা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা। আর এক ‘সা’ এর ওজন ছিল নবী কারীম সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম- এর ‘সা’ অনুযায়ী।- মুয়াত্তা মালেক পৃ. ১২৪. আল ইসতিযকার, হাদীস: ৫৮৯, ৯/৩৪৮
এ হাদীসে রাসূলের যুগে এবং সাহাবাদের আমলে সদকা ফিতর কোন কোন বস্তু দ্বারা আদায় করা হত তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
(খ) হযরত আব্দুলাহ ইবনে ওমর (রা) সারা জীবন খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তিনি একবার মাত্র যব দ্বারা আদায় করেছেন।- আলইসতিযকার, হাদীস: ৫৯০, ৯/৩৫৪
ইবনে কুদামা (রা) আবূ মিজলাযের বর্ণনা উলেখ করে বলেন, এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশই যেহেতু খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন তাই ইবনে ওমর (রা) সাহাবীদের তরীকা অবলম্বন করতে সারা জীবন খেজুর দ্বারাই আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে ওমরের ভাষ্য হল-
‘সাহাবাগণ যে পথে চলেছেন, আমিও সে পথেই চলতে আগ্রহী।’
এবার দেখা যাক মাযহাবের ইমামগণ উত্তম সদকা ফিতর হিসেবে কোনটিকে গ্রহন করেছেন।
উত্তম সদকা ফিতর
ইমাম শাফেয়ীর মতে উত্তম হল হাদীসে বর্ণিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা দেওয়া। অন্য সকল ইমামের মতও এমনই ইমাম মালিক (রহ) এর নিকট খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত খেজুর ‘আজওয়া’ খেজুর দেওয়া উত্তম। আজওয়া খেজুরের ন্যূনতম মূল্য ১০০০-১২০০ টাকা প্রতি কেজি।
ইমাম আহমদ (রহ) এর নিকট সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো।- আল মুগনী ৪/২১৯; আওজাযুল মাসালিক ৬/১২৮।
ইমাম আবু হানীফা (রহ) এর নিকটেও অধিক মূল্যের দ্রব্যের দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরীবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক ‘সা’ খেজুরের সমপরিমাণ ছিল। নবী কারীম সালালাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর যুগে মদীনাতে গমের ফলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীতে হযরত মুআবিয়া (রা) এর যুগে ফলন বৃদ্ধি পেলেও মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। একাধিক বর্ণনায় এসেছে যে, সেকালে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক ‘সা’ খেজুরের সমপরিমাণ ছিল।
হযরত মুআবিয়া (রা) এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ‘সা; গমকে সদকা ফিতরের অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের এক ‘সা’র মতো গণ্য করা হত।- আল ইসতিযকার ৯/৩৫৫।
ইবনুল মুনযির বলেন-
সাহাবীদের যুগে যখন গম সহজলভ্য হল তখন তারা আধা ‘সা’ গমকে এক ‘সা’ যবের সমতুল্য গণ্য করলেন।- ফাতহুল মুলহিম ৩/১৫; আওজাযুল মাসালিক ৬/১৩।
তাহলে বুঝা গেল যে, হযরত মুআবিয়া (রা) এর যুগে গম দ্বারা সদকা ফিতর আদায়ের প্রচলন বেড়েছিল। এর কারণ হল যে, তখন গমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্য মানের খাদ্য। এ সময় হযরত ইবনে ওমর সাহাবাদের অনুকরণে খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করতেন। তখন তাঁকে আবূ মিজলায (রহ) বললেন-
‘আলাহ তাআলা তো এখন সামর্থ্য দিয়েছেন। আর গম খেজুরের চেয়ে অধিক উত্তম। অর্থাৎ আপনার সামর্থ্য রয়েছে বেশি মূল্যের বস্তু সদকা করার। তবুও কেন খেজুর দ্বারা তা আদায় করছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাহাবাদের অনুকরণে এমন করছি।
যাক, আমাদের কথা ছিল, সাহাবায়ে কিরাম গম দ্বারা এ জন্যই সদকা ফিতর আদায় করতেন যে, এর মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিল। হাদীসে পাঁচ প্রকারের খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে গমের মূল্য সবচেয়ে কম। তাহলে এ যুগে সর্ব শ্রেণীর জন্য এমনকি সম্পদশালীদের জন্যও শুধুই গম বা তার মূল্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করা কী করে সমীচীন হতে পারে?
বড়ই আশ্চর্য! পুরো দেশের সব শ্রেণীর লোক বছর বছর ধরে সর্বনিম্ন মূল্যের হিসাবে ফিতরা আদায় করে আসছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সকলেই ফিতরা দিচ্ছে একই হিসাবে জনপ্রতি ৫৫/৬০ টাকা করে। মনে হয় সকলে ভুলেই গেছে যে, গম হচ্ছে ফিতরার ৫টি দ্রব্যের একটি (যা বর্তমানে সর্বনিম্ন মূল্যের)।
সুতরাং আমরা এদেশের ফিতরা আদায়কারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি তারা যেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী হাদীসে বর্ণিত দ্রব্যগুলোর মধ্যে তুলনামূলক উচ্চমূল্যের দ্রব্যটির হিসাবে ফিতরা আদায় করেন। পনির, কিসমিস, খেজুর কোনোটির হিসাব যেন বাদ না পড়ে। ধনীশ্রেণীর মুসলিম ভাইদের জন্য পনির বা কিসমিসের হিসাবে ফিতরা আদায় করা কোনো সমস্যাই নয়। যেখানে রমযানে ইফতার পাটির নামে ল ল টাকা ব্যয় করা হয়, ঈদ শপিং করা হয় অঢেল টাকার, সেখানে কয়েক হাজার টাকার ফিতরা তো কোনো হিসাবেই পড়ে না। যদি এমনটি করা হয়, তবে যেমনিভাবে পুরো হাদীসের উপর মুসলমানদের আমল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একটি হারিয়ে যাওয়া সুন্নত যিন্দা করা হবে, তেমনি এ পদ্ধতি দারিদ্রবিমোচনে অনেক অবদান রাখবে। গরীব- দুঃখীগণের মুখেও হাসি ফুটে উঠবে ঈদের পবিত্র দিনে।
আরেকটি আবেদন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দেশের সম্মানিত মুফতীগণ, মাশায়েখ হযরত ও দারুল ইফতাগুলোর কাছে, তারা যেন সদকাতুল ফিতর এর পরিমাণ ঘোষণা দেওয়ার সময় হাদীসে বর্ণিত সকল দ্রব্যের হিসাবেই পৃথক পৃথকভাবে বলে দেন এবং মানুষকে যথাসম্ভব উচ্চমূল্যের ফেতরা আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করেন। আলাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন