Main Slogan:

হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর (সূরা বাকারা : ২০৮)
রাছুলুল্লাহ্(সাঃ) লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রাছুলুল্লাহ্(সাঃ) লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৩

রাসূল (সা.) এর ভালবাসা

রাসূল (সা.) এর ভালবাসা
- মুহাম্মদ আমিনুল হক

হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ, সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বোত্তম নবী ও রাসূল। তাঁর উপর ঈমান রাখা ও তাঁকে নিজের চেয়েও ভালবাসা মুমিনের একান্ত কর্তব্য। পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফের একাধিক বর্ণনায় মুমিনদেরকে রাসূল (সা.) এর প্রতি অগাধ প্রেম-ভালবাসা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: ‘‘বল, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের পত্নী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং বাসস্থান -যাকে তোমরা পছন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাহে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর, আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়েত করবেন না’’ (সূরা আত তাওবাহ:২৪)। তিনি আরো বলেন: ‘‘নবী মুমিনদের কাছে তাদের নিজেদের চেয়েও অধিক ঘনিষ্ঠ’’ (সূরা আল আহযাব:০৬)। নবী (সা.) বলেন: ‘‘তোমাদের মধ্যে কেউ ঈমানদার হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা, সন্তান এবং সকল মানুষের চাইতে প্রিয় হই’’ (বুখারী ও মুসলিম)। আব্দুল্লাহ ইবনে হিশাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমরা নবী (সা.) এর সাথে ছিলাম। নবী (সা.) হযরত ওমর (রা.) এর হাত ধরা ছিলেন। অত:পর ওমর (রা.) রাসূল (সা.)কে বললেন: হে রাসূল আমি আপনাকে সবচাইতে বেশি ভালবাসি তবে আমার নিজের চাইতে বেশি নয়। নবী (সা.) বললেন: তাহলে হবে না; আল্লাহর শপথ! তোমার নিজের চাইতেও আমাকে বেশি ভালবাসতে হবে। তখন ওমর (রা.) বললেন: এখন আমি আপনাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসি। অত:পর নবী (সা.) বললেন: হে ওমর তাহলে এখন ঠিক আছে’’ (বুখারী)।
রাসূল (সা.) কে ভালবাসার নমুনা:
মানুষ একে অপরকে ভালবাসে হৃদয়ে ও বিশ্বাসে; যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় তার আচার আচরণ ও কর্মে। নবী (সা.)কে ভালবাসলে তার আলামত নিশ্চয়ই আমাদের কাজে কর্মে থাকতে হবে। যারা নবী (সা.)কে ভালবাসেন তাদের মধ্যে নিম্নের আলামতগুলো বিদ্যমান থাকা আবশ্যক।
এক. রাসূল (সা.) কে সম্মান করা: এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘‘আমিতো আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষ্য প্রদানকারী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে। যাতে তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আন এবং রাসূলকে সাহায্য কর ও সম্মান কর এবং সকালে সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবীহ পাঠ কর’’ (সূরা আল ফাতহ: ৮-৯)। আমাদেরকে সব সময় নবী (সা.) কে সম্মান করতে হবে। নবী (সা.) যতটুকু মর্যাদার হক্বদার আমাদেরকে ততটুকুই মর্যাদা দিতে হবে এতে কোন কার্পণ্য করা যাবে না। রাসূল (সা.) কে সম্মান করতে গিয়ে আমাদেরকে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে- যেমন:
ক. নবী (সা.) এর সামনে উঁচুস্বরে কথা না বলা: নবী (সা.) যখন জীবিত ছিলেন তখন তাঁর সামনে উচু আওয়াজেও কথা বলা নিষেধ ছিল। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন: ‘‘হে তোমরা যারা ঈমান এনেছ! তোমরা তোমাদের কণ্ঠস্বরকে রাসূলের কণ্ঠস্বরের উপর উঁচু করো না এবং তোমরা তাঁর সাথে এমন উঁচু স্বরে কথা বলো না; যেমন তোমরা একে অপরের সাথে উচু স্বরে কথা বলে থাক। এতে তোমাদের কর্মফল বিনষ্ট হয়ে যাবে, অথচ তোমরা টেরও পাবে না’’ (সূরা আল হুজুরাত: ০২)। তিনি আমাদের মাঝে এখন আর বিদ্যমান না থাকলেও তাঁর কথামালা রয়ে গেছে। তাই কুরআনের এ আয়াতের দিকে লক্ষ্য রেখে রাসূল (সা.) নিসৃত বাণী মনোযোগ ও সম্মানের সাথে শুনতে হবে এবং তা যথাযথভাবে আমল করতে হবে। রাসূলের কোন কথাকেই বিকৃত করার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। যে সমস্ত দায়ী ইলাল্লাহ ও আলেমে দ্বীন রাসূলের বাণী প্রচার করেন; তাঁদেরকেও সম্মান করতে হবে।
খ. রাসূল (সা.) এর উপর ছালাত ও ছালাম পড়া: নবী (সা.) এর উম্মতের কর্তব্য হচ্ছে- রাসূল (সা.) এর উপর ছালাত ও ছালাম পেশ করা। এটি তাঁদের উপর ফরজ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফিরিস্তাগণ নবীর উপর ছালাম পেশ করে। অতএব, হে ঈমানদারগণ তোমরাও তাঁর উপর ছালাত ও ছালাম পেশ কর’’ (সূরা আল আহযাব: ৫৭)। এ প্রসঙ্গে নবী (সা.) বলেন: ‘‘যে ব্যক্তির সামনে আমার নাম উচ্চারিত হল; অথচ সে আমার উপর ছালাম পেশ করল না সে কৃপণ’’ (আহমদ)। তিনি এ প্রসঙ্গে আরো বলেন: ‘‘তার নাক ধুলায় মলিন হোক যে আমার নাম শুনেও আমার উপর ছালাম পেশ করল না’’ (আহমদ)। 
দুই: রাসূল (সা.) ও তাঁর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখা: রাসূল (সা.) কে ভালবাসার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে- তাঁকে এবং তাঁর সুন্নাতকে সবসময় সমুন্নত রাখার চেষ্টা করা। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: ‘‘এ সম্পদে হক রয়েছে মুহাজিরদের, যারা নিজেদের ঘর-বাড়ি ও ধন-সম্পদ থেকে উৎখাত হয়েছে। তারা কেবল অন্বেষণ করে আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি এবং তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাহায্য করে। তারাই তো সত্যবাদী’’ (সূরা আল হাশর: ০৮)। সাহাবীগণ রাসূল (সা.) কে ও তাঁর সুন্নাতকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন। সব কিছুর উর্ধে রাসূলকে মর্যাদা দিতেন। তাঁর আদেশ-নিষেধ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতেন। রাসূলের আদর্শকে সমুন্নত রাখাই ছিল তাঁদের একমাত্র সাধনা। সাহাবায়ে কিরামের জিন্দেগী পর্যালোচনা করলে তাঁদের রাসূল প্রেমের অসংখ্য নজির দেখতে পাওয়া যায়। রাসূলের জন্য তাঁরা তাঁদের জীবন কুরবান করে ইতিহাস রচনা করেছেন। আমাদেরকেও তাই রাসূলের আদর্শ ও তাঁর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতে হবে। রাসূল (সা.) এর সুন্নাতকে সমুন্নত রাখার অর্থ হচ্ছে- রাসূলের সুন্নাত সব জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করা, একে বিশুদ্ধ রাখা, এর অপপ্রয়োগ না করা, অপব্যাখ্যা না করা ও চরমপন্থী ও বিদয়াতপন্থীদের হাত থেকে রক্ষা করা। আর যারা রাসূলের হাদীস কেন্দ্রিক বিভিন্ন সন্দেহ ও অপবাদ প্রচার করে তাদের বিরুদ্ধে সঠিক জবাব দেয়া। তাদের মিথ্যা প্রচারণাকে মানুষের সামনে যুক্তি দিয়ে অসার প্রমাণ করা।
তিন: রাসূল (সা.) যা বলেছেন তা সত্য বলে মেনে নেয়া: ঈমানের অন্যতম দাবী হচ্ছে- রাসূল (সা.) কে সকল প্রকার মিথ্যা ও অপবাদের উর্ধে রাখা। তিনি যা বলেছেন সত্য বলেছেন, এই বিশ্বাস হৃদয়ে ধারন করা। তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা খবর দিয়েছেন তাকে সত্য জানা। এ প্রসংঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি এবং বিপথগামীও হননি। এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কুরআন অহী, যা প্রত্যাদেশ হয়’’ (সূরা আন নাজম:১-৪)। নবী (সা.) কে অপবাদ দেয়া ও তাঁর কথাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা কুফুরী। এ কারণেই আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদেরকে নিন্দা জ্ঞাপন করে বলেন: ‘‘আর কুরআন সে জিনিস নয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কেউ তা বানিয়ে নেবে। অবশ্য এটি পূর্ববর্তী কালামের সত্যায়ন করে এবং সে সমস্ত বিষয়ের বিশ্লেষণ দান করে যা তোমার প্রতি দেয়া হয়েছে, যাতে কোন সন্দেহ নেই- তোমার বিশ্বপালনকর্তার পক্ষ থেকে। মানুষ কি বলে যে, এটি বানিয়ে এনেছ? বলে দাও, তোমরা নিয়ে এসো একটিই সূরা, আর ডেকে নাও, যাদেরকে নিতে সক্ষম হও আল্লাহ ব্যতীত, যদি তোমরা সত্যবাদী হও’’ (সূরা ইউনুস:৩৭-৩৮)।
চার: রাসূল (সা.) এর অনুসরণ ও আনুগত্য: রাসূল (সা.) কে মহববত করার অন্যতম নিদর্শন হচ্ছে- নবী (সা.) যা বলেছেন এবং যা করেছেন তার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও আনুগত্য করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্যে রাসূলুল্লাহর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে। (সূরা আল-আহযাব:২১)। রাসূল (সা.) এর আনুগত্য করা ফরজ। এ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের অনেক নির্দেশনা রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক’’ (সূরা আল-হাশর:৭)। আল্লাহ তায়ালা রাসূলের আনুগত্যকে তাঁর আনুগত্য হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহর আনুগত্য করে’’ (সূরা আন-নিসা: ৮০)। রাসূল (সা.) এর আনুগত্যের বিষয়ে অনেক হাদীস বিধৃত হয়েছে। নবী (সা.) বলেন: ‘‘তোমাদের কর্তব্য হচ্ছে- আমার এবং খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতকে আকড়ে ধরা। এবং তা শক্তভাবে দাঁত কামড়িয়ে যেভাবে ধরে সেভাবে ধরবে। সাবধান! তোমরা ধর্মের মধ্যে নতুন বিষয় থেকে দূরে থাকবে। নিশ্চয়ই প্রত্যেক নতুনত্বই (ধর্মের মধ্যে) বিদয়াত। আর প্রত্যেক বিদয়াতই ভ্রষ্টতা’’ (আহমদ, আবু দাউদ, তিরমিযি)। অতএব, প্রত্যেক কাজে রাসূলের অনুগত্য করাই হচ্ছে রাসূলের মহববত। আর তাই রাসূলের মহববত যত বাড়বে রাসূলের আনুগত্যও তত বাড়বে। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘‘বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমাকে অনুসরণ কর, যাতে আল্লাহও তোমাদিগকে ভালবাসেন’’ (সূরা আল-ইমরান: ৩১)। 
পাঁচ: আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) কে সর্ব বিষয়ে চূড়ান্ত ফয়সালাকারী হিসেবে মেনে নেওয়া: মানব সমাজ বিবাদের উর্ধে নয়। সমাজের বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন বিষয়ে মতদ্বৈততা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে এই বিবাদ মিটানোর জন্য আমাদেরকে রাসূল (সা.) এর নীতি অনুসরণ করতে হবে। তিনি যে পথনির্দেশ দেখিয়েছেন সেটিকেই চূড়ান্ত হিসেবে মেনে নিতে হবে। রাসূল (সা.) কে ভালবাসার এটিও একটি নজির। যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে সর্ব বিষয়ে শালিস মানতে পারেন না তিনি মুসলমান দাবি করতে পারেন না। এ প্রসংগে আল্লাহ বলেন: ‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহ ও রাসূলের এবং তাদের যারা তোমাদের মধ্যে ফয়সালার অধিকারী। তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে মতভেদ কর, তবে তা প্রত্যার্পণ কর আল্লাহ তাঁর রাসূলের প্রতি। যদি তোমরা ঈমান এনে থাক আল্লাহ এবং শেষ দিবসের প্রতি। আর এটাই উত্তম এবং পরিণামে কল্যাণকর’’ (সূরা আন-নিসা:৫৯)। তিনি আরও বলেন: ‘‘তবে না; আপনার রবের কসম! তারা মুমিন হবে না যে পর্যন্ত না তারা আপনার উপর বিচারের ভার অর্পণ করে সেসব বিবাদ-বিসম্বাদের যা তাদের মধ্যে সংঘটিত হয়, তারপর তারা নিজেদের মনে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ বোধ না করে আপনার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে এবং সর্বান্তকরণে তা মেনে নেয়’’ (সূরা আন-নিসা:৬৫)। যারা নিজেদেরকে মুসলমান দাবি করে অথচ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ফয়সালা মেনে নেয় না তারা মূলত: মুনাফিক; ইসলামের সাথে তাঁদের সম্পর্ক থাকতে পারে না। আল্লাহ বলেন: ‘‘আপনি তাদের দেখেননি যারা দাবি করে যে, আপনার প্রতি যা নাযিল হয়েছে এবং আপনার পূর্বে যা নাযিল হয়েছে তাতে তারা বিশ্বাসী? অথচ তারা বিচারপ্রার্থী হতে চায় তাগুতের কাছে, যদিও তাদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করতে। আর শয়তান তাদের পথভ্রষ্ট করে বহু দূরে নিতে চায়। আর যখন তাদের বলা হয়, এস আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তার দিকে এবং রাসূলের দিকে, তখন আপনি মুনাফিকদের দেখবেন আপনার কাছ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুখ ফিরিয়ে সরে যাচ্ছে’’ (সূরা আন-নিসা: ৬০-৬১)।
রাসূল (সা.) কে ভালবাসার নামে বাড়াবাড়ি : আমাদের সমাজে অনেকেই আছেন যারা রাসূল (সা.)কে মহববত করতে গিয়ে বাড়াবাড়ি করেন। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। রাসূল মাটির তৈরী নয়, তিনি গায়েব জানেন, দুনিয়া ও আদম সৃষ্টির আগে রাসূলকে সৃষ্টি করা হয়েছে, নবী (সা.) কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক এরকম অসংখ্য অশুদ্ধ কথা বাজারে প্রচলিত আছে। এই সমস্ত বাড়াবাড়ি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল পছন্দ করেন না। আল্লাহ বলেন: ‘‘আর এটিই আমার সরল সঠিক পথ, অতএব তোমরা এ পথেই চল, বক্র পথে চলো না। চললে সেসব পথ তোমাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলবে’’ (সূরা আল-আনয়াম: ১৫৩)। নবী (সা.) তাঁর সম্পর্কে অতিরিক্ত প্রশংসা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন: ‘‘তোমরা আমার অতিরিক্ত প্রশংসা করো না; যেভাবে ইহুদীরা ঈসা ইবনে মরিয়মকে নিয়ে করেছে। আমি কেবল আল্লাহর বান্দা। অতএব তোমরা বল: আমি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’’ (বুখারী)। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একদা একব্যক্তি নবী (সা.) কে বললেন: আপনি এবং আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। তখন নবী (সা.) বলেন: তুমি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানিয়ে ফেললে; বরং তুমি বল, একমাত্র আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে’’ (আহমদ)। এভাবে অনেক হাদীসে নবী (সা.) তাঁকে নিয়ে অতিরিক্ত ভক্তি, প্রশংসা ও যেকোন ধরনের বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।
পরিশেষে আমি সকল মুসলিম ভাই-বোনদের উদ্যেশ্যে বলতে চাই যে, রাসূল (সা.) কে আমাদের হৃদয় দিয়ে ভালবাসতে হবে; কিন্তু সে ভালবাসা যেন হয় শরীয়তের গন্ডির মধ্যে থেকেই। আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা রাসূল (সা.) কে ভালবাসতে গিয়ে এমন কথা বলেন বা বিশ্বাস রাখেন যা মূলত: আল্লাহর শানে মানায়। এরকম কথা ও বিশ্বাসকে পরিহার করে রাসূল (সা.) যা করতে বলেছেন এবং তিনি যা করেছেন তার হুবহু অনুকরণ করতে পারলেই তাঁর পরম ভালবাসার পাত্র হওয়া যাবে, অন্যথায় নয়। মনে রাখা দরকার, রাসূলের নামে মিলাদ-মাহফিল কিংবা রাসূল (সা.) এর নাম শুনে মুখে আঙ্গুল নিয়ে চুমু খেয়ে চোখে লাগানো ও জশনে জুলুস করা যত প্রয়োজন তাঁর চেয়ে বেশি প্রয়োজন মসজিদে গিয়ে জামায়াতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, বছরে একবার রমজান মাসে শুদ্ধভাবে রোযা রাখা, ইসলামের বিধান মানা, হারাম থেকে দূরে থাকা, সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজে বাধা দেয়া, ব্যক্তি, পরিবার ও রাষ্ট্রের মধ্যে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করা। এগুলোর মধ্যেই রাসূলকে পাওয়া যাবে; পাওয়া যাবে তাঁর মহববত। রাসূল (সা.) এর নামে মিলাদ-মাহফিল করলাম কিন্তু তাঁর আদর্শকে বুকে ধারণ করতে পারলাম না এটি দু:খজনক। আমি যাকে ভালবাসব তাকে তার পছন্দ অনুযায়ী ভালবাসতে হবে; না হয় ভালবাসা হয় না; হয় প্রতারণা। রাসূলকে ভালবাসতে হলে তাই রাসূলের নির্দেশিত পন্থায়ই তাঁকে ভালবাসতে হবে; নচেৎ এই সমস্ত নেফাকী ভালবাসা দিয়ে আল্লাহর রেজামন্দি হাসিল সম্ভব নয়; নয় রাসূলের খাঁটি উম্মত হওয়া। আল্লাহ আমাদেরকে রাসূল (সা.)-এর পরিশুদ্ধ ভালবাসা অর্জনের তাওফীক দিন। আমীন।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
ই-মেইল: aminulhoque_iiuc@yahoo.com


রাসূল (সা.) এর প্রতি ভালোবাসা | ইসলাম ও জীবন |

সোমবার, ৩ জানুয়ারী, ২০১১

নবী পরিবারের ফজিলত সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস

নবী পরিবারের ফজিলত সম্পর্কিত কয়েকটি হাদিস
মাওলানা মাহমূদুল হাসান
অনেক হাদিসে অকাট্যভাবে আহলে বাইত তথা নবী পরিবারের প্রতি মহব্বত প্রদর্শনের গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে এবং তাদের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বুখারি শরিফের এক রেওয়ায়েতে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) বলেন, 'আল্লাহর কসম! আমার আত্মীয়তার তুলনায় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্ল্লামের আত্মীয়তার মূল্যায়ন আমার কাছে অধিক পছন্দনীয়।'মুসলিম শরিফের রেওয়ায়েতে হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, রাসূলে পাক ইরশাদ করেন : 'হে মানুষ! আমি মানুষ, অতি নিকটতম সময়ে আমার নিকট আল্লাহ পাকের দূত আসবে, সে এলে তার আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। তাই আমি তোমাদের জন্য দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি, একটি হচ্ছে আল্লাহ পাকের কিতাব; এর মধ্যে হেদায়েত এবং নূর বিদ্যমান রয়েছে। তোমরা আল্লাহর এই কিতাবকে আঁকড়ে ধরবে এবং এই কিতাব মোতাবেক আমল করবে।'

আল্লাহর কিতাবের প্রতি অনুপ্রাণিত করার পর তিনি ইরশাদ করেন: 'আমি তোমাদেরকে আহলে বাইতের ব্যাপারে আল্লাহ পাককে স্মরণ রাখতে বলছি।' এ কথা রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার ইরশাদ করেন। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-এর হাদিসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: 'তোমরা আল্লাহ পাককে মহব্বত কর। কারণ, তিনি তোমাদেরকে তাঁর নেয়ামত থেকে রিজিক দান করেছেন; আর আমাকে মহব্বত কর আল্লাহ পাকের মহব্বতের জন্য এবং আমার মহব্বতের জন্য আহলে বাইতকে মহব্বত কর!' তাবরানীর রেওয়ায়েতে হজরত জাবিরের সূত্রে বর্ণিত_ হজরত ওমর (রা.) উম্মে কুলছুম বিনতে আলীকে বিবাহ করার পর উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ করে বলেন: তোমরা আমাকে মুবারকবাদ জানাও; কারণ আমি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, কিয়ামতের দিন নসবের সম্পর্কসহ সব সম্পর্কই ছিন্ন হয়ে যাবে, কেবল আমার নসবের সম্পর্ক অটুট থাকবে।

লেখক : খতিব, গুলশান সেন্ট্রাল জামে মসজিদ

রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০১০

বিশিষ্ট নবীদের সাথে সাক্ষাতের রহস্য



বিশিষ্ট নবীদের সাথে সাক্ষাতের রহস্য
- সায়মা রহমান কাশ্মীর

মিরাজের রাতে কতিপয় বিশিষ্ট নবীর সাতে রসূলুলস্নাহ (স.)-এর সাক্ষাৎ হয়েছিল। এ সাক্ষাতের সহস্য সম্পর্কে কোন আলেম কিছু তথ্য পেশ করেছেন। তা এইঃ ১) মিরাজের রাতে ১ম আকাশে রসূলুলস্নাহ (সা:)-এর সাথে হযরত আদম (আ.)-এর সাক্ষাত হয়। অন্যদের মতে, আদমকে যেহেতু জান্নাত থেকে পৃথিবীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল সেহেতু তাঁর সাথে প্রথমেই রসূলুলস্নাহর (স.) সাক্ষাৎ হওয়াতে একথার সতর্কবাণী রয়েছে যে, রসূলুলস্নাহ (স.) কেও তাঁর মাতৃভূমির মায়া ত্যাগ করে মদীনার দিকে হিজরত করতে হবে। তাঁদের দু'জনের মধ্যে সামঞ্জস্য এই যে, দু'জনকেই প্রিয়ভূমি ত্যাগ করার কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তারপর দু'জনেরই পরিণতি সেই প্রিয় ভূমিতেই প্রত্যাবর্তন হয়েছে যেখানে থেকে তাঁদের দু'জনকে বের করো দেয়া হয়েছিল (ফাতহুল বারী, ৭ম খন্ড, ২১০ পৃষ্ঠা)।

২) ২য় আকাশে হযরত ঈসা (আ.)-এর সাথে রসূলুলস্নাহর সাক্ষাৎ হয়। তা এই জন্য যে, তিনিই রসূলুলস্নাহ (সা:)-এর সবচেয়ে কাছাকাছি সময়ের নবী (ফাতহুল বারী, ৭ম খণ্ড, ২১১ পৃষ্ঠা)।

৩) ৩য় আকাশে হযরত ইউসুফ (আ.) -এর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়।

ইউসুফের ভাইয়েরা যেমন তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। তেমনি রসূলুলস্নাহকে (স.) তাঁর কুরাইশ-ভাইয়েরা হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল। এমতাবস্থায় শেষ পরিণতি ইউসুফেরই হাতে থাকে। তেমনি ঐরূপ পরিণতি রসূলুলস্নাহ্রও হয়েছিল। যেমন তিনি মক্কাবিজয়ের দিন কুরাইশদেরকে সেই কথাটিই বলেছিলেন যে কথাটি ইউসুফ (আ.) তাঁর ভাইদের বলেছিলেন: লা-তাস্রীবা আলাইকুমুল ইয়াও্ম্ঃ আজকের দিনে তোমাদের প্রতি কোন রকমই অভিযোগ নেই (ঐ-৭২ পৃষ্ঠা)।

৪) ৪র্থ আকাশে হযরত ইদরীস (আ.)-এর সাথে রসূলুলস্নাহর (স.) সাক্ষাৎ হয়। হযরত ইদরীস (আ.) সম্পর্কে আলস্নাহ বলেন:- অরাফা'না-হু মাকা-নান আলিয়্যা-আমি তাঁকে উচ্চমর্যাদা দান করেছি। তেমনি মিরাজের মাধ্যমে আলস্নাহ রসূলুলস্নাহ (স.) কে উচ্চমর্যাদা ভূষিত করেছেন (ঐ-২১১ পৃষ্ঠা)।

৫) ৫ম আকাশে হযরত হারুনের (আ.) সাথে রসূলুলস্নাহ্র সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর রহস্য হিসাবে ভাবা হয় যে, হারুনকে তাঁর জাতি কষ্ট দেয়ার পরে যেমন তাঁকে তারা ভালবেসেছিল। তেমনি রসূলুলস্নাহ্র কওমও তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন দেবার পর তাঁর প্রতি অঢেল প্রেম ঢেলে দিয়েছিল- (ঐ-২১১ পৃষ্ঠা)।

৬) ৬ষ্ঠ আকাশে মূসা নবীর সাথে তাঁর (স.) সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার রহস্য এই যে, মূসা (আ.) কে তাঁর কওম খুব্ই কষ্ট দিয়েছেল। যেমন নবী (স.) ঐদিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, মূসাকে এর চেয়েও বেশী কষ্ট দেয়া হয়েছিল। তথাপি তিনি তা সহ্য করেছেন (ঐ-২১১ পৃষ্ঠা) তেমনি মুহাম্মদ (স.) কেও অমানুষিক কষ্ট দেয়া হয়েছে।

৭) ৭ম আকাশে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল হযরত ইবরাহীম নবীর সাথে। তখন তিনি (স.) তাঁকে ৭ম আসমানে ফেরেশতাদের তাওয়াফের ঘর বাইতুল মা'মুরে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলেন। এর রহস্য এই যে, রসূলুলস্নাহ (স.) ৭ম হিজরীতে মক্কায় প্রবেশ করবেন এবং যমীনের কাবা বাইতুলস্নাহর তাওয়াফ করবেন। তিনি ৬ষ্ঠ হিজরীতে মক্কাতে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাঁর দুশমনরা তাঁকে বাধা দেয়। ফলে তিনি ৭ম হিজরীতে মক্কায় প্রবেশ করেন এবং বাইতুলস্নাহ্র তাওয়াফ করেন (ফাতহুল বারী, ৭ম খণ্ড, ২১১ পৃষ্ঠা)।

তেমনি হযরত রসূলুলস্নাহ (সাঃ)-এর হাবীবুলস্নাহ (অন্তরঙ্গ বন্ধু) হওয়াটা খলীলুলস্নাহর চেয়েও যেন আরো উচ্চ হয়। তাই মুহাম্মদ সালস্নালস্না-হু আলাইহি অসালস্নাম ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর চেয়েও উঁচুতে উঠে ক্বা-বা কাওসাইন আও্ আদ্না পর্যন্ত (তীরের রশি ও ডাং-এর মাঝের মত) তিনি আলস্নাহ্র কাছে কিংবা তার চেয়েও বেশী কাছে পেঁৗছে যান (ঐ-২১১ পৃষ্ঠা)।

বুধবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১০

ঘুষ ও দুর্নীতি দমনে মহানবী (স.) প্রণীত পদক্ষেপসমূহ



ঘুষ ও দুর্নীতি দমনে মহানবী (স.) প্রণীত পদক্ষেপসমূহ

তোমরা অন্যায়ভাবে একে অপরের সম্পদ গ্রাস করোনা এবং মানুষের ধন-সম্পত্তির কিছু অংশ জেনে শুনে অন্যায় পন্থায় আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে শাসনকর্তা বা বিচারকদের হাতে উৎকোচ (ঘুষ) তুলে দিওনা (সুরা বাকারা-১৮৮ আয়াত)। আলস্নাহ্ রাব্বুল আলামীন এখানে ঘুষের প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। এবং বিচারকদের হাতে ঘুষ দিয়ে রায় নিজের পক্ষে নিতেও বারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বিষয়টি যেন হালাল হিসেবে পরিলক্ষিত হয়ে আসছে। কারণ সরকারী-বেসরকারী প্রায় সকল অফিসেই ঘুষের বিনিময়েই বেশির ভাগ কাজ সুরাহা করা হয়। ঘুষের অংক যত বেশি হয় ফাইল ততো দ্রুতগতিতে দেঁৗড়াতে শুরু করে। আর ঘুষ ছাড়া কোন ফাইলই যেন নড়াচড়া করে না। সমাজের অসহায় এবং ক্ষমতাহীন মানুষেরা তাদের হূত অধিকার কিংবা অন্যের অধিকারকে করায়ত্ব করার লক্ষ্যে ধূর্ত দুনর্ীতিপরায়ণ কর্তা বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে অবৈধ অর্থ কিংবা পণ্যসামগ্রী পর্দার অন্তরালে প্রদান করে স্বার্থ হাছিল করার নিমিত্তে উৎকোচ প্রদান করে থাকে। যা মানব বিধ্বংসী গুরুতর অপরাধ। এর মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বান্দার হক বা অধিকারও ক্ষুণ্ন হয়। যে অপরাধ ক্ষমা করা না করার বিষয়টি স্বয়ং আলস্নাহতায়ালা বান্দার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। বান্দা ক্ষমা না করলে আলস্নাহতায়ালা এই অপরাধ কখনোই ক্ষমা করবেন না।

ঘুষ গ্রহণ করা নিন্দনীয় ও গুনাহের কাজ বলে রসুল (সঃ) তার হাদীসেও উলেস্নখ করেছেন। হযরত আব্দুলস্নাহ ইবনে ওমর (রা.) হতে বর্ণিত রসুল (সঃ) বলেন, ঘুষ দাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়ই জাহান্নামে যাবে (তাবারাণী)। হযরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণিত অন্য হাদীসে আছে যে ঘুষদাতা ও ঘুষ গ্রহীতা উভয়কেই রসুল (সঃ) লানত করেছেন (আবু দাউদ)। হযরত ছাওবান (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রসুল (সঃ) ঘুষ দাতা ও গ্রহীতা এবং ঘুষের দালাল সকলের উপর লানত করেছেন (আহমদ তাবারাণী)। এই পৃথিবীতে মান-মর্যাদা ও সম্মান-প্রতিপত্তির অধিকারী হওয়ার মাঝেই সার্থকতা রয়েছে। বিত্ত-বৈভবের প্রাচুর্য-এর তুলনায় মানুষ মান-সম্মান অর্জনের জন্যই দেদারছে সম্পদ ব্যয় করে। অন্য বিষয়ে ব্যয়ের সীমাবদ্ধতা থাকলেও এই খাতে তার ব্যয়ের সীমা পরিসীমা থাকে না। সম্পদের একটা উলেস্নখযোগ্য অংশ মানুষ তার মান-সম্মান ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের পিছনে ব্যয় করে থাকে। মানব জীবনের প্রকৃত সার্থকতা হলো মান-মর্যাদা অর্জন।

আর এর মোকাবেলায় অর্থ-বিত্ত একেবারেই মূল্যহীন বস্তু। তাই যখন কেউ ঘুষ গ্রহণ করে তখন তার মানসম্মান ধুলোয় মিশে যায়। ঘুষ গ্রহীতা দুর্নীতিবাজগণ গভীরভাবে ভেবে দেখুন যে, এটা আপনাদের আত্মমর্যাদা বিনাশের এক বিরাট আত্মঘাতী পদক্ষেপ এবং বংশ মর্যাদার জন্য এক অশুভ লক্ষণ। আলস্নাহ্র ভয়ে মানুষ যে কোন ধরনের অন্যায় কাজ হতে দূরে থাকে। কিন্তু ঘুষ-মানুষের অন্তর থেকে আলস্নাহ্ভীতি দূর করে দেয়। ঘুষের কারণে মানবিক আচরণ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মুহূর্তেই মানুষ অমানুষে পরিণত হয়। পরম সহিষ্ণুতার, অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা, সততা, কর্তব্য নিষ্ঠা, লজ্জাশীলতা, ন্যায়পরায়ণতা, অন্যায় প্রতিরোধের স্পৃহা এবং আত্মসম্মানবোধের মতো মানবিক সুকুমার বৃত্তিগুলি ঘুষের প্রভাবে মানুষ হারিয়ে ফেলে। ঘুষ কুরআন হাদীস স্বীকৃত নিষিদ্ধ বিষয়। সুরা বাকারার ১৬৮ আয়াতে আলস্নাহ তায়ালা বলেন, হে মানবজাতি। জমিনের মধ্যে যা কিছু রয়েছে, তা থেকে তোমরা হালাল ও পবিত্র বস্তুসমূহ খাও। আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করোনা, কেন না সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু। অনুরূপভাবে সুরা নাহলে বলা হয়েছে তোমাদেরকে আলস্নাহ তায়ালা যে পবিত্র ও হালাল রুজি দান করেছেন তা থেকে তোমরা খাও এবং আলস্নাহর নেয়ামতসমূহের শুকরিয়া আদায় করো, যদি তোমরা তাঁরই উপাসক হয়ে থাকো। পৃথিবীতে জীবন পরিচালনা করতে অর্থের প্রয়োজনীয়তা এবং অপরিহার্যতা সম্পর্কে যেমন সবাই একমত, তেমনি অর্থ-সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রেও ভাল ও মন্দ তথা বৈধ-অবৈধ দু'টি ব্যবস্থার ব্যাপারেও দুনিয়ার সবাই একমত। দুনিয়ার সবাই মন্দ বলে মনে করে থাকে চুরি, ডাকাতি, ধোকা, ঘুষ, জুয়া প্রভৃতি কাজকে। এই পন্থাগুলোর মধ্যে বৈধ ও অবৈধ নির্ধারণের কোনো মানদণ্ড সাধারণ মানুষের কাছে নেই। এ বিষয়গুলো নির্ধারণ করেছেন স্বয়ং আলস্নাহতায়ালা ও তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সঃ) যা দেশ-কাল ও গোত্র গোষ্ঠী নির্বিশেষে সকলের নিকটই সমভাবে গ্রহণযোগ্য এবং শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। মূলতঃ ঘুষ হারাম করার পিছনে কারণ হলো এই যে, এতে জনসাধারণের অধিকার ক্ষুণ্ন হয়ে থাকে। এর ফলে কতিপয় ব্যক্তি ফুলে ফেপে বড় লোক বনে যায় আর বৃহত্তর অংশ দারিদ্র্য কবলিত হয়ে পড়ে। ঘুষ চার প্রকার (১) ক্ষমতাসীন হওয়ার জন্য নেতৃত্ব ও পদবী লাভের জন্য, নিজের সপক্ষে রায় দেয়ার জন্য উচ্চ পর্যায়ের বা নিম্ন পর্যায়ের লোকদেরকে যা দেয়া হয় তা ঘুষ (২) ন্যায়কে অন্যায় ও অন্যায়কে ন্যায় বানানোর জন্যে যা ব্যয় করা হয় তাও ঘুষ। উক্ত দুই প্রকারের ঘুষদাতা, ঘুষখোর ও ঘুষের দালাল রসুল (সঃ) এর হাদীস অনুযায়ী অভিশাপ প্রাপ্ত ও জাহান্নামী (৩) নিজের প্রকৃত হক উদ্ধারের জন্য কর্মকর্তা বা তার নিকট সুপারিশকারীকে কিছু দেয়া। (৪) কোন অত্যাচারী জালিম ব্যক্তি হতে বা তার জুলুম থেকে নিজের এবং পরিবার পরিজনের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষার সম্ভব হচ্ছে না। সেই ক্ষেত্রে অসহায় ও নিরুপায় অবস্থায় ঘুষ দেয়ার বিষয়ে কিছুটা অবকাশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু গ্রহীতার ক্ষেত্রে সকল অবস্থায় ঘুষ নেয়া হারাম এবং হাদীসের ভাষায় সে অভিষপ্ত ও জাহান্নামী। হযরত আবু উমামা (রা.) হতে বর্ণিত। রসুল (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি কারো জন্য কোনো সুপারিশ করলো আর এজন্য সুপারিশ প্রাপ্ত ব্যক্তি তাকে কোনো হাদিয়া দিল এবং সে তা গ্রহণ করলো তবে নিঃসন্দেহে সে ঘুষের দরজাসমূহের মধ্য হতে একটি বড় দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো (আবু দাউদ) আমাদের সমাজে যারা পৈত্রিক সূত্রে মুসলমান তারা এ সমস্ত বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে না। যার ফলে এ সমস্ত অন্যায়গুলো সমাজ জীবন হতে নিমর্ূল হয় না। রসুল (সঃ) এর অন্য একটি হাদীসে আরো পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে, সামাজিক বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য কি কারণে সৃষ্টি হয় হযরত আমর ইবনে আস (রা.) হতে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, আমি রসুল (সঃ) কে বলতে শুনেছি, যে সমাজে যেনা-ব্যভিচার সুদ-ঘুষ, দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে অথচ এর কোন বিচার হয় না। সেই সমাজ দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষের করাল গ্রাসে নিপতিত না হয়ে পারে না। আর যে সমাজে ঘুষের কারবার ছড়িয়ে পড়ে সে সমাজে ভীতি ও সন্ত্রাস সৃষ্টি না হয়ে পারে না (মুসনাদে আহমদ) এই হাদীস থেকে সন্ত্রাস সৃষ্টির কারণ ও মূল উৎস কোথায় তা জানা সহজ হলো।

অন্য একটি হাদীসে বলা হয়েছে কোন কাজ উদ্ধার করার জন্য যা কিছু দেয়া হয় তা সবই ঘুষের পর্যায়ে পড়ে। যেমন হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুল (সঃ) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কাউকে ঋণ দেয় আর ঋণ গ্রহীতা যদি তাকে কোন হাদীয়া দেয় কিংবা তার যানবাহনে বিনা ভাড়ায় চড়তে বলে তখন যেন সে তার হাদিয়া বা উপটৌকন গ্রহণ না করে এবং বিনা ভাড়ায় তার যানবাহনেও না চড়ে। অবশ্য পূর্ব থেকেই যদি তাদের উভয়ের মধ্যে এরূপ লেন-দেনের ধারা চলে আসে তবে তা ভিন্ন কথা (ইবনে মাজাহ) সুতরাং যারা মুসলিম বলে দাবি করেন ও ইসলামী অনুশাসনে নিজেদের জীবনকে ঢেলে সাজাতে চায় তারা অবশ্যই এ সমস্ত সামান্য ব্যাপারেও সতকর্তা অবলম্বন করবে। তা নাহলে সব আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে ও তার পরিণতি হবে খুবই ভয়াবহ। আলস্নাহ্র রসুল (সঃ) এ প্রসঙ্গে বলেন, "আর রাশি অল মুরতাশি কিলাহুমা ফিন নার" ঘুষ দাতা, ঘুষ গ্রহীতা এবং ঘুষের লেনদেনে সহযোগিতাকারীগণ সকলেই অভিষপ্ত ও জাহান্নামী।

আমাদের বুঝতে হবে যে, পৃথিবীর জীবন আসল জীবন নয়। এটি একটি পরীক্ষার ক্ষেত্র। প্রকৃত জীবন হলো পরকালের জীবন। যে জীবনের কোনো শেষ নেই। সেই জীবনে সুখী হওয়াই প্রকৃত সুখ। নশ্বর এই দুনিয়ায় সামান্য কয়টা দিন সুখী হওয়ার জন্য লোভ লালসার বশবর্তী হয়ে সুদ, ঘুষ, দুর্নীতিতে জড়ালে তা হবে নিজেই নিজেকে ধ্বংসস্তুপে নিক্ষেপের নামান্তর। আমাদের মধ্যে যারা এ সমস্ত কাজে জড়িত তাদের সকলকে এই পাপের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে সত্য-ন্যায়ের পথে হালাল জীবিকা নির্বাহ করে জীবন-যাপন করার তাওফিক আলস্নাহ্তায়ালা দান করুন, আমীন।

-মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী

Relaeted Other Islamic Blog

Other Blog-site: