-মাওলানা মুহাম্মদ ফয়জুল্লাহ
সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে মেহেদি অনুষ্ঠানের জমজমাট আয়োজন ছাড়া
বিবাহ-শাদির চিন্তাও করা যায় না। এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিরাট পরিকল্পনা ও
পূর্বপ্রস্ত্ততি গ্রহণ করা হয়। খরচের হিসাবও গুণতে হয় লম্বা-চওড়া। এই
অনুষ্ঠান ছাড়া বিয়ের অনুষ্ঠান যেন পানসে হয়ে যায়। বিয়ের মূল পর্ব থেকে অনেক
বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হচ্ছে মেহেদি অনুষ্ঠানকে। সাধারণত
বিবাহপূর্ব রাতে এই মেহেদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে বরপক্ষ
প্রস্ত্তত মেহেদি পাত্র নিয়ে মহা ধূমধামে কনের বাড়িতে উপস্থিত হয়। এই
অনুষ্ঠানে থাকে নিম্নে বর্ণিত কিছু সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ও ব্যবস্থাপনা।
দামি পাত্রে অত্যন্ত যত্ন সহকারে মেহেদি সাজানো হয়। এই পাত্র নিয়ে বর ও
কনে পক্ষ পরস্পরের ঘরে গমন করে। বর পক্ষের রমণীরা কনের ঘরে গিয়ে কনের হাতে
মেহেদি রং করে দিয়ে আসে। অনুরূপ কনে পক্ষও বরকে তাই করে। উভয় পক্ষের বাড়িতে
অত্যন্ত রুচিপূর্ণ দামি খাবারের আয়োজন করা হয়। অতঃপর ধূম-ধাড়াক্কা
নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকে। যুগলবন্দী যুবক-যুবতীরা নাচ গানে অংশগ্রহণ
করে। বেহায়াপনা বেলেল্লপনার নির্লজ্জ প্রদর্শনী হয়। পর পুরুষ অত্যন্ত
তৃপ্তি সহকারে সেই নাচ-গান উপভোগ করে। ফটকা, আতশবাজি, তারাবাতি ইত্যাদি
জমকালো পর্বের আয়োজন করা হয়। তথাকথিত মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে কল্যাণও
প্রত্যাশা করা হয়। হাতে লাগানো হয় রাখিবন্ধন ইত্যাদি। এক মারাত্মক
পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আলো-অাঁধারিতে অষোঘিত ও অপ্রকাশিতভাবে অনেক মা-বোনের
সম্ভ্রম হানি হয়। মোদ্দাকথা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর নিষেধ করা সব
অপকর্ম এই অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে হতে থাকে।
এই অনুষ্ঠান অত্যন্ত ন্যক্কারজনকভাবে অপব্যয়ের এক মহোউৎসবে পরিণত হয়। এই
কুসংস্কার অন্য মানুষকেও অপব্যয়ে উদ্বুদ্ধ করে। এ ব্যাপারে আল্লাহ্
তা’য়ালা ইরশাদ করেন- (অর্থ:) ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দান করো এবং
অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। আর কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা
শয়তানের ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।’ (বনী ইসরাঈল-
৬-২৭)
অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলে বিকট শব্দের গান-বাজনা, নৃত্য,
ব্যন্ডশো ইত্যাদি। ইসলামী শরীয়তের আলোকে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ্
তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘‘এক শ্রেণীর লোক আছে যারা মানুষকে আল্লাহ্র পথ থেকে
গোমরাহ করার উদ্দেশ্যে অবান্তর কথাবার্তা সংগ্রহ করে অন্ধভাবে এবং উহাকে
নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে অবমাননাকর শাস্তি।’ (লোকমান- ৬)
আল্লামা ইবনে কাসীর (রাহ.) আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেন, ‘হযরত
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা.) তিনবার কসম করে বলেছেন, ‘লাহওয়াল হাদীস’-
দ্বারা গান-বাজনাই উদ্দেশ্য। হযরত ইবনে আববাস (রা.), হযরত জাবের (রা.),
হযরত ইকরামা (রা.) এবং সাঈদ ইবনে জুবায়ের (রা.) উল্লেখিত আয়াতের অনুরূপ
তাফসীর করেছেন।
মেহেদি অনুষ্ঠানের আকর্ষণীয় ও গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে নৃত্য।
নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীর অশ্লীল নির্লজ্জ নাচ দর্শক-শ্রোতাদের উত্তেজিত
করে, মোহিত করে। ফলে ইভটিজিংসহ নানা ধরনের মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়।
মানুষ উত্তেজনায় অস্থির হয়ে নারীদের শ্লীলতাহানির মত ঘটনাও ঘটিয়ে বসে।
মেহেদি অনুষ্ঠানে এমন সব অনৈসলামিক কার্যকলাপ করা হয় যার দ্বারা ঈমান
শূন্য হয়ে যায়। ঈমান তাদের আল-বিদা দিয়ে চলে যায়। কেননা, এই অনুষ্ঠানে
প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত ব্যক্তিগণ উক্ত পাপকে পাপ মনে করে না। বরং কৃত
পাপকে অহংকার, গর্ব এবং আনন্দকর বিষয় হিসেবে বিশ্বাস করে। আর এমন বিশ্বাস
তার ঈমানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সা.) কর্তৃক হারামকৃত
কাজকে হালাল বিশ্বাস করলে তার ঈমান অটুট থাকে না।
এই অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে নির্লজ্জতার মহড়া হয়। পর্দাহীনতা চরম আকার ধারণ
করে। নারী-পুরুষ একাকার হয়ে যায়। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।
অনুষ্ঠানে অপ্রয়োজনীয় আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা হয়। আতশবাজি, ফটকা, বিজলি
বাতি ইত্যাদির বিশেষ আয়োজন করা হয়। যা অপচয় এবং অপব্যয়ের অন্তর্ভুক্ত।
কুরআন-সুন্নাহ্র দৃষ্টিতে যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও বর্জনীয়। আল্লাহ্ তায়ালা
ইরশাদ করেন- ‘এবং তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না, কৃপণতাও করে না
এবং তাদের পন্থা হয় এতদুভয়ের মধ্যবর্তী।’
(আল ফুরকান- ৬৭)
এই মেহেদি অনুষ্ঠানটি ঐতিহাসিকভাবে হিন্দুদের প্রচলনকৃত কুসংস্কার এবং এটা তাদের ঘোষিত সংস্কৃতি। যার অনুসরণ ও পালন করাই পাপ।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি যে জাতির সাদৃশ্য গ্রহণ
করবে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ কোনো মুসলমানের আত্মসম্মান কি হিন্দু
সংস্কৃতি গ্রহণ করে নিজেকে তাদেরই একজন হিসেবে সাব্যস্ত করার অনুমতি দিতে
পারে? না, কখনোই না। প্রকৃত মুসলমানের দ্বারা এটা অসম্ভব।
হ্যাঁ, একথা সত্য ও নির্ভুল যে, নারীরা নব বধুকে মেহেদি লাগাতে পারে।
সখীরা তাকে নিয়ে বিয়ের গান গাইতে পারে। দেশ জাতির নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী
নির্মল আনন্দ করতে পারে, এতে কোনো বাধা, প্রতিবন্ধকতা নেই। কিন্তু এর জন্য
রীতিমতো অনুষ্ঠান করে ইসলামী শরীয়াবিরোধী কার্যকলাপের জোয়ার বইয়ে দেয়া
সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অতএব আসুন, আমরা এ ধরনের অনুষ্ঠান বন্ধ করি, বর্জন করি।
মা-বোনেরা, আসুন এর প্রতিবাদ করি। এ ধরনের অনুষ্ঠান বর্জন করার উদ্যোগ
গ্রহণ করি। নিজেরা বাঁচি, অন্যকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামেয়া কোরআনিয়া আরাবিয়া, লালবাগ, ঢাকা।
Source: http://www.mashikdeendunia.com