Main Slogan:

হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর (সূরা বাকারা : ২০৮)

বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১০

ইভটিজিং রোধে ইসলামী অনুশাসন


মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম

ইভটিজিং বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত একটি বিষয়। এটি একটি সামাজিক ব্যাধি হিসেবে রূপ নিয়েছে। ইদানীং বাংলাদেশে এ সমস্যা প্রকট আকারে দেখা দিয়েছে। যার শিকার হচ্ছে বিভিন্ন বয়সের নারী, বিশেষ করে স্কুল-কলেজগামী মেয়েরা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইভটিজাররা বখাটে, লম্পট ও মাদকাসক্ত হয়ে থাকে বলে মান হারানোর ভয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ ছেলেরাও মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য ইভটিজিং করে থাকে। তারা মনেই করে না যে এটা এক ধরনের অপরাধ। ফলে নিরীহ মেয়েরা চরম বিব্রত ও অপমানিত হয়। পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে মানসিক সাপোর্ট না পেয়ে, অপমান সহ্য করতে না পেরে রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে আত্মহননের পথ বেছে নেয় অনেক সময়। ইভটিজিংয়ের শিকার হয়ে পিংকি, সিমি, তৃষা, কাজলী, ইলোরা, বৃষ্টি ও ফাহিমাদের মতো নাম না জানা অনেকেই অকালে ঝরে গেছে।
ইভটিজিং বলতে আমরা বুঝি মেয়েদের উত্ত্যক্তকরণ। এমন ধরনের আচরণকে বোঝায় যা মেয়েদের যৌন হয়রানি, শ্লীলতাহানি বা অসৌজন্যমূলক আচরণের মাধ্যমে নারীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্যে ফেলা। এক গবেষণায় জানা যায়, বাংলাদেশে ১০-১৮ বছর বয়সী মেয়েদের প্রায় ৯০ ভাগ নিয়মিত ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন। ইভটিজিং নিয়ে প্রতিনিয়ত আলোচনা-সমালোচনা, সভা-সমাবেশ, গোলটেবিল বৈঠক ও সেমিনারের আয়োজন করা হচ্ছে, বিভিন্নজন নানা দৃষ্টিকোণ থেকে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং এর কারণ উল্লেখ করেছেন। মূলত আমরা ইভটিজিংয়ের মূল কারণ হিসেবে যা উল্লেখ করব, তা হলো নৈতিকতার অবক্ষয় ও ইসলামী অনুশাসন তথা ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব। যাদের সামাজিকীকরণ ইসলামী অনুশাসনের মাধ্যমে হয়নি, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ছোঁয়া পায়নি, কুশিক্ষা বা নোংরা পরিবেশে বল্গাহীন-বেপরোয়াভাবে বড় হয়েছে; তাদের দ্বারাই মেয়েরা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষার আলো নেই এবং ইসলামী চেতনাবোধ নেই। তারা খাও-দাও ফূর্তি কর, দুনিয়াটা মস্ত বড় এই নীতিতে বিশ্বাসী। অপরদিকে যারা ইভটিজিংয়ের শিকার হন তাদের দায়ভার কোনো অংশে কম বলা যায় না। মেয়েরা এমনিতেই আল্লাহপাকের আকর্ষণীয় সৃষ্টি। উপরন্তু যদি মেয়েরা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করতে গিয়ে ছেলেদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য নিজেকে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে, তাহলে তো দুর্ঘটনার উপলক্ষ তৈরি হতেই পারে। মেয়েদের দেহসৌষ্ঠব ও মোহিনীশক্তি ছেলেদের মস্তিষ্কে এক ধরনের উত্তেজক বার্তা পাঠায়। ধর্মীয় মূল্যবোধ, আত্মসংবরণ করার শক্তি বা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে সেটাই টিজিং হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
ইভটিজিং নামক এ সামাজিক ব্যাধি রোধ করার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু বিরাজমান অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না, অবনতিও রোধ করা যাচ্ছে না। ইসলাম আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগেই এর সুন্দর একটি সমাধান দিয়েছে। তা হলো পর্দা ফরজ করা হয়েছে। পর্দা ব্যবস্থায় নারী-পুরুষের জন্য এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিধান রাখা হয়েছে যা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও কার্যকর। ইভটিজিং প্রতিরোধে পর্দা প্রথা অত্যন্ত কার্যকরী একটি ব্যবস্থা।
কোনো পর্দানশিন মেয়ে ইভটিজিংয়েংর শিকার বা কোনোভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন শোনা যায়নি। পর্দানশিন ও শালীন পোশাকে আবৃত কোনো মেয়েকে দেখলে বখাটেরা নিরুত্সাহী হয়ে রাস্তা ছেড়ে দেয়। নিজের অজান্তেই তাদের মধ্যে এক ধরনের শ্রদ্ধাবোধ চলে আসে। তাই শালীন ও ভদ্র পোশাক পরিধান করার ব্যাপারে উত্সাহিত করা হয়েছে। জনসম্মুখে জাঁকজমকপূর্ণ, অশালীন এবং বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ করে এমন পোশাক পরিধান করার ব্যাপারে ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। শরীরের অঙ্গগুলোতে পর্দা করার জন্যই পোশাকের প্রবর্তন করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন—‘হে বনি আদম! আমি তোমাদের জন্য পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি দেহাবরণ বস্ত্র। আর পরহেজগারির পোশাকই হচ্ছে সর্বোত্তম।’ (সূরা-আরাফ, আয়াত-২৬)
শালীন পোশাক মহিলাদের সম্ভ্রান্ত হিসেবে উপস্থাপন করে এবং ইভটিজিংসহ অন্যান্য নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করে। পবিত্র কোরআনে এরশাদ করা হয়েছে—‘হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী-কন্যা ও মুসলিম নারীদের জানিয়ে দিন, তারা যেন তাদের শরীরের ওপর চাদর ঢেকে দেয়, তাতে সহজেই তাদের চিনতে পারা যাবে (সম্ভ্রান্ত মহিলা হিসেবে) এবং তাদের আর নির্যাতিতা হতে হবে না, তারা বেইজ্জতি থেকে রক্ষা পাবে।’ (সূরা-আহজাজ, আয়াত-৫৯)
পাশ্চাত্যে নারীরা নিজেদের পুরুষদের সামনে উপস্থাপন করার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। আর এর অনুকরণে মুসলিম নারীরা নিজেদের আকর্ষণীয় হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য অশালীন পোশাক পরিধান করার ব্যাপারে ইসলামে কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বলা হয়েছে—‘আর মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। তারা যেন যা এমনিতেই প্রকাশমান এমন সৌন্দর্য ছাড়া তাদের কোনো রকম সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন তাদের ওড়নাকে বক্ষদেশে দিয়ে রাখে এবং তারা যেন তাদের স্বামী, পিতা, শ্বশুর, নিজ ছেলে, স্বামীর ছেলে, আপন ভাই, আপন ভাতুষ্পুত্র, আপন ভাগ্নে, মুসলিম মহিলা, ক্রীতদাস ও দাসী, কামভাবমুক্ত বৃদ্ধ ও এমন নাবালক যারা এখনও নারীর গোপনীয়তা সম্পর্কে বোঝে না—শুধু তাদের ছাড়া আর কারও কাছে সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে।’ (সূরা-নূর, আয়াত-৩২)
ইসলামে শুধু যে নারীদের পর্দা করতে বলা হয়েছে, তা নয়। পুরুষদেরও তাদের দৃষ্টি ও যৌনাঙ্গ হেফাজত করতে বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! মুমিন পুরুষদের বলুন তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। এতে তাদের জন্য রয়েছে উত্তম পবিত্রতা। নিশ্চয়ই তারা যা করে আল্লাহ তা অবহিত আছেন। এবং ঈমানদার নারীদের বলুন তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করে।’ (সূরা-নূর, আয়াত-৩১)
শর্টকাট পোশাক পরে আল্ট্রামডার্ন হওয়ার মধ্যে নেই কোনো সম্মান, নেই নিরাপত্তা। বরং ইসলামী পোশাক ও সংস্কৃতি ধারণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইহকালীন শান্তি ও পরকালীন মুক্তি। এ প্রসঙ্গে আমেরিকান মহিলা সাংবাদিক ‘হেলেনে’র কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি আরব দেশ ভ্রমণকালে নারীদের পর্দা প্রথা ও সামাজিক ব্যবস্থা দেখে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন—‘আরবীয় সমাজ সুষ্ঠু সমাজ। আরবদের সামাজিক নীতিমালা এতই উপযোগী যে প্রতিটি তরুণীর তা গ্রহণ করা উচিত। আমেরিকা ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশে তো এরকম সুশীল সামাজিক অবস্থা অনুপস্থিত। সে দেশগুলোতে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশার নিঃশর্ত অনুমতি দেয়া হয়েছে, চারিত্রিক গুণাবলীর কোনো সুনাম নেই। সব ধরনের অশ্লীলতা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির অন্তরালে সেখানকার সমাজ উন্মাদনা ও বিশৃঙ্খলায় পরিপূর্ণ।’
সবশেষে আশাবাদের সঙ্গে এটুকু বলা যায়, আমাদের দেশে যদি ইসলামী মূল্যবোধ ও অনুশাসন ব্যাপক হারে অনুসরণ করা যায়, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে যদি ইসলামী মূল্যবোধ ও চেতনাটুকু জগিয়ে দেয়া যায় তাহলে আইন করে নয়, এমনিতেই ইভটিজিংসহ অন্য সব রকমের অপরাধ করার প্রবণতা ন্যূনতম পর্যায়ে চলে আসবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ইসলামী ইতিহাসের ছাত্র

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Relaeted Other Islamic Blog

Other Blog-site: