Main Slogan:

হে ইমানদারগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর (সূরা বাকারা : ২০৮)
রোজা-সদাকাতুল ফিতর-ঈদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
রোজা-সদাকাতুল ফিতর-ঈদ লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০২২

আরাফার দিনের রোজা’ কবে রাখব?

- মৌলানা আবু রায়হান বিন মুস্তাক


জিলহজের প্রথম দশ দিন অতি বরকতপূর্ণ। আল্লাহতায়ালার পক্ষ থেকে মুমিনদের জন্য বিশেষ উপহার।
এই দশ দিনের আমল ও ইবাদত আল্লাহর কাছে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি প্রিয়। কোরআন ও হাদিসের অসংখ্য বর্ণনায় জিলহজের দশ দিনের আমল-ইবাদতের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
এই দশ দিনের পুরো সময়টাই তো আমলের। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম সব ধরনের আমলই এ সময়ে করতেন। রোজা রাখাও এ সময়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল।
হাদিসে ইয়াওমে আরাফা বা ‘আরাফার দিনের রোজা’ রাখার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
আবু কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ‘আরাফার’ দিনে সিয়াম পালনের ফজিলতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন- আমি মনে করি, আরাফার দিনে সিয়াম পালনে আল্লাহতায়ালা বিগত বছরের গুনাহ ও আগামী বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম: হাদিস ১১৬২)
হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত- রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিলহজের নবম দিন সিয়াম পালন করতেন এবং সিয়াম পালন করতেন আশুরার দিনে৷ (সুনানে আবু দাউদ, নাসায়ী, মুসনাদে আহমাদ)
বিখ্যাত হাদিস বিশারদ আল্লামা মুবারকপুরী রহ. বলেছেন- হাফসা (রা.)-এর এ বর্ণনায় নবীজি জিলহজের নবম দিন রোজা রাখতেন; এটা সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে এবং এই দিনটিই ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন। (মিন্নাতুল মুনইম শরহু সহীহ মুসলিম ২/২১১)
উপরোক্ত উভয় হাদিসের বর্ণনায় বিষয়টি স্পষ্ট যে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন হল সব জনপদের নিজ নিজ হিজরি তারিখ হিসেবে ৯ জিলহজ, ৮ জিলহজ নয়! কারণ এই রোজা আরাফা বা আরাফায় অবস্থান সংক্রান্ত আমল নয়।
বরং ৯ তারিখের বিশেষ আমল। কাজেই আমাদের দেশের হিসেবে ৮ জিলহজ সৌদি আরবে হাজীদের আরাফায় অবস্থান হলেও আমরা রোজা রাখব ৯ তারিখেই।
দুই.
‘ইয়াওমে আরাফা’ হচ্ছে ওই তারিখের (৯ জিলহজের) পারিভাষিক নাম।
যেহেতু হজের প্রধান রোকন ‘আরাফায় অবস্থান’ তারিখ হিসাবে ৯ জিলহজে আদায় করা হয়, তাই এ তারিখেরই নাম পড়ে গেছে ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিন।
এ কারণে যেসব আমল আরাফা বা আরাফায় অবস্থানের সঙ্গে বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং জিলহজের ৯ তারিখের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ বা আরাফার দিনের আমল হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
তাই ৯ জিলহজের রোজাকে আরাফার দিনের রোজা হিসেবে অভিহিত করা হয়।
তিন.
ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন যে ৯ জিলহজ এর আরেকটি দৃষ্টান্ত হলো- ‘তাকবিরে তাশরিক’ সংক্রান্ত হাদিস।
এটি আরাফা বা হাজীদের আরাফায় অবস্থানের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো বিশেষ আমল নয়। এটি শুরু হয় ৯ জিলহজ ফজর থেকে।
অথচ যে দলিল দ্বারা ৯ তারিখ থেকে তাকবিরে তাশরিক শুরু হওয়া প্রমাণিত তাতেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ আরাফার দিন শব্দই আছে।
আলী রাদিআল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন- নবীজি ইয়াওমে আরাফা বা আরাফার দিন (৯ জিলহজ) ফজরের পর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত তাকবিরে তাশরিক পাঠ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস: ৫৬৭৭)
এখানেও ‘ইয়াওমে আরাফা’ অর্থ ৯ জিলহজ। আর ৮ জিলহজ আরাফার দিনের রোজার প্রবক্তাদের কাছেও তাকবিরে তাশরিক ৯ জিলহজ থেকে শুরু হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত এবং এর স্বপক্ষে দলিলও উপরোক্ত এই হাদিস!
চার.
গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমা আছে যে, ইয়াওমে আরাফার পরের দিনটিই ইয়াওমুন নাহর। হাদিসেও এ ধারাবাহিকতা প্রমাণিত ‌রয়েছে।
এটি প্রমাণ করে, ‘ইয়াওমে আরাফা’ একটি তারিখের নাম। আর তা হচ্ছে ৯ জিলহজ আর ‘ইয়াওমুন নাহর’ও একটি তারিখের নাম। আর তা হচ্ছে ১০ জিলহজ ঈদের দিন।
কারণ আমাদের দেশের হিসেবে ৮ জিলহজকে ইয়াওমে আরাফা মেনে নিলে ইয়াওমে আরাফা ও ইয়াওমুন নাহরের মাঝে আরেকটি দিন স্বীকার করে নেয়া জরুরি। অথচ এটা ইজমার সরাসরি বিরোধী।
সুতরাং বোঝা গেল, এ জাতীয় বিচ্ছিন্ন চিন্তা ও বক্তব্য আরো কিছু ক্ষেত্রেও বিচ্ছিন্নতাকে অনিবার্য করে তুলবে।
কাজেই আমরা বিচ্ছিন্ন কথাকে না মেনে উম্মাহর ঐকমত্য সিদ্ধান্ত মেনে আগামী শনিবার ৯ জিলহজের এই ফজিলত পূর্ণ রোজা রাখার নিয়ত করি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বোঝার এবং আমলের তাওফিক দান করুন আমিন।

বুধবার, ১৫ আগস্ট, ২০১২

সদাকাতুল ফিতর সংক্রান্ত জরুরী মাসায়িল



সদাকাতুল ফিতর সংক্রান্ত জরুরী মাসায়িল 
-    মুফতী ইহতিশামুল হক নোমান
প্রয়োজনে: ০১৭১৪৬১৯১৬০

যাদের উপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব
ক্স    ঈদুল ফিতরের দিন সোবহে সাদেকের সময় যার নিকট যাকাত ওয়াজিব হওয়া পরিমাণ অর্থ/ সম্পদ থাকে তার উপর সদকায়ে ফিতর বা ফেতরা ওয়াজিব। তবে যাকাতের নেসাবের েেত্র ঘরের আসবাবপত্র বা ঘরের মূল্য ইত্যাদি হিসেবে ধরা হয় না; কিন্তু ফেতরার েেত্র অত্যাবশ্যকীয় আসবাবপত্র ব্যতীত অন্যান্য আসবাবপত্র সৌখিন দ্রব্যাদি, খালিঘর বা ভাড়ার ঘর (যার ভাড়ার উপর তার জীবিকা নির্ভরশীল নয়) এসব কিছুর মূল্য হিসেবে ধরা হবে।

ক্স    রোযা না রাখলে বা রাখতে না পারলে তার উপর ফেতরা দেয়া ওয়াজিব।

ক্স    সদকায়ে ফিতর / ফিতরা নিজের প থেকে এবং পিতা হলে নিজের না-বালেগ সন্তানের প থেকে দেয়া ওয়াজিব। বালেগ সন্তান, স্ত্রী, স্বামী, চাকর-চাকরানী, মাতা-পিতা প্রমুখের প থেকে দেয়া ওয়াজিব নয়। তবে বালেগ সন্তান পাগল হলে তার প থেকে দেয়া পিতার উপর ওয়াজিব।

ক্স    একান্নভুক্ত পরিবার হলে বালেগ সন্তান, মাতা, পিতার প থেকে এবং স্ত্রীর প থেকে ফেতরা দেয়া মুস্তাহাব- ওয়াজিব নয়। (বেহেশতী যেওর [বাংলা])

ক্স    সদকায়ে ফিতর ওয়াজিব না হলেও সঙ্গতি থাকলে দেয়া মুস্তাহাব এবং অনেক সওয়াবের কাজ। (ঐ)

সদাকাতুল ফিতরের পরিমাণ ঃ
ক্স    ফিতরায় ৮০ তেলার সেরের হিসেবে ১ সের সাড়ে বার ছটাক (১ কেজি ৬৬২ গ্রাম) গম বা আটা কিংবা তার মূল্য দিতে হবে। পূর্ণ দুই সের (১ কেজি ৮৬৬ গ্রাম) বা তার মূল্য দেয়া উত্তম।

ক্স    ফিতরায় যব দিলে ৮০ তোলার সেরের হিসেবে ৩ সের নয় ছটাক (প্রায় ৩ কেজি ৫২৩ গ্রাম) দিতে হবে। পূর্ণ ৪ সের (৩ কেজি ৭৩২ গ্রাম) দেয়া উত্তম।

ক্স    গম, আটা ও যব ব্যতীত অন্যান্য খাদ্য শষ্য যেমন ধান, চাউল, বুট, কলাই, মটর ইত্যাদি দ্বারা ফেতরা আদায় করতে চাইলে বাজার দরে উপরোক্ত পরিমাণ গম বা যবের যে মূল্য হয় সেই মূল্যের ধান চাউল ইত্যাদি দিতে হবে।

ক্স    ফিতরায় গম, যব ইত্যাদি শষ্য দেয়ার চেয়ে তার মূল্য- নগদ টাকা-পয়সা দেয়া উত্তম।

সদাকাতুল ফিতর কখন আদায় করবে

ক্স    ফিতরা ঈদুল ফিতরের দিন ঈদের নামাযের পূর্বেই দিয়ে দেয়া উত্তম। নামাযের পূর্বে দিতে না পারলে পরে দিলেও চলবে। ঈদের দিনের পূর্বে রমযানের মধ্যে দিয়ে দেয়াও দুরস্ত আছে।

সদাকাতুল ফিতর কাকে দিবে ঃ
ক্স    যাকে যাকাত দেয়া যায় তাকে ফেতরা দেয়া যায়।
ক্স    একজনের ফেতরা একজনকে দেয়া বা একজনের ফেতরা কয়েকজনকে দেয়া উভয়ই দুরস্ত আছে। কয়েক জনের ফেতরাও একজনকে দেয়া দুরস্ত আছে; কিন্তু তার দ্বারা যেন সে মালিকে নেসাব না হয়ে যায়। অধিকতর উত্তম হল একজনকে এই পরিমাণ ফেতরা দেয়া, যার দ্বারা সে ছোট-খাট প্রয়োজন পূরণ করতে পারে বা পরিবার পরিজন নিয়ে দু’তিন বেলা খেতে পারে। (মাও: হেমায়েতুদ্দীনকৃত আহকামে যিন্দেগী: ২৩২-২৩৩)

সদাকাতুল ফিতর আদায় সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা ঃ
সদকায়ে ফিতর সম্পর্কিত হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। যব, খেজুর, পনির, কিসমিস ও গম। এ পাঁচ প্রকারের মধ্যে যব, খেজুর, পনিরও কিসমিস দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করতে চাইলে প্রত্যেকের জন্য এক সা’ দিতে হবে। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আঁধা সা’ দিতে হবে। এটা হল ওজনের দিক দিয়ে তফাত। আর মূল্যের দিক থেকে তো পার্থক্য রয়েছেই। যেমন-
(ক)    আজওয়া (উন্নতমানের) খেজুরের মূল্য প্রতি কেজি ১০০০/- টাকা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৩২৫৬/- (তিন হাজার দুইশত ছাপান্ন) টাকা।

(খ)    মধ্যম ধরনের খেজুর যার মূল্য প্রতি কেজি ৩০০/- টাকা হারে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৯৭৭/- (নয়শত সাতাত্তর) টাকা।

(গ)    কিসমিস প্রতি কেজি ২৩০/- টাকা করে হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ৭৪৮/- (সাতশত আটচলি­শ) টাকা।

(ঘ)    পনির প্রতি কেজি ৫০০/- (পাঁচশত) টাকা করে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতর দাঁড়ায় ১৬২৮/- (এক হাজার ছয়শত আটাশ) টাকা।

(ঙ)    গম প্রতি কেজি ৩৫/- টাকা হিসেবে ধরা হলে একজনের সদকায়ে ফিতরা দাঁড়ায় ৫৭/- টাকা।

হাদীসে এ ৫টি দ্রব্যের যে কোনটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যে কোনো ১টি দ্বারা তা আদায় করতে পারে। এখন ল্যণীয় বিষয় হল, সকল শ্রেণীর লোক যদি সবচেয়ে নিম্ন মূল্য-মানের দ্রব্য দিয়েই নিয়মিত সদকা আদায় করে তবে হাদীসে বর্ণিত অন্য চারটি দ্রব্যের হিসেবে ফিতরা আদায়ের উপর আমল করবে কে? আসলে এেেত্র হওয়া উচিত ছিল এমন যে, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সদকা ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসাবে দেওয়ার সে তাই দিবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারে। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিউ উত্তম নিয়ম। এ নিয়মই ছিল নবী, সাহাব, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের স্বর্ণযুগে। এ পর্যন্ত কোথাও দুর্বল সূত্রে একটি প্রমাণ মেলেনি যে, স্বর্ণযুগের কোনো সময়ে সব শ্রেণীর সম্পদশালী সর্বনিম্ন মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করেছেন। এখানে এ সংক্রান্ত কিছু বরাত পেশ করা হচ্ছে।

হাদীস
নবী কারীম সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­ামকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন-

‘দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি।’- সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইতাক ৩/১৮৮; সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান বাব আফযালুল আমল ১/৬৯।

সাহাবায়ে কিরাম এর আমল
(ক) হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা) বলেন,
‘আমরা সদকা ফিতর আদায় করতাম এক ‘সা’ খাদ্য দ্বারা অথবা এক ‘সা’ যব অথবা এক ‘সা’ খেজুর কিংবা এক ‘সা’ পনির বা এক ‘সা’ কিসমিস দ্বারা। আর এক ‘সা’ এর ওজন ছিল নবী কারীম সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম- এর ‘সা’ অনুযায়ী।- মুয়াত্তা মালেক পৃ. ১২৪. আল ইসতিযকার, হাদীস: ৫৮৯, ৯/৩৪৮
এ হাদীসে রাসূলের যুগে এবং সাহাবাদের আমলে সদকা ফিতর কোন কোন বস্তু দ্বারা আদায় করা হত তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।

(খ) হযরত আব্দুল­াহ ইবনে ওমর (রা) সারা জীবন খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তিনি একবার মাত্র যব দ্বারা আদায় করেছেন।- আলইসতিযকার, হাদীস: ৫৯০, ৯/৩৫৪

ইবনে কুদামা (রা) আবূ মিজলাযের বর্ণনা উলে­খ করে বলেন, এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশই যেহেতু খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন তাই ইবনে ওমর (রা) সাহাবীদের তরীকা অবলম্বন করতে সারা জীবন খেজুর দ্বারাই আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে ওমরের ভাষ্য হল-

‘সাহাবাগণ যে পথে চলেছেন, আমিও সে পথেই চলতে আগ্রহী।’
এবার দেখা যাক মাযহাবের ইমামগণ উত্তম সদকা ফিতর হিসেবে কোনটিকে গ্রহন করেছেন।

উত্তম সদকা ফিতর
ইমাম শাফেয়ীর মতে উত্তম হল হাদীসে বর্ণিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা দেওয়া। অন্য সকল ইমামের মতও এমনই ইমাম মালিক (রহ) এর নিকট খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত খেজুর ‘আজওয়া’ খেজুর দেওয়া উত্তম। আজওয়া খেজুরের ন্যূনতম মূল্য ১০০০-১২০০ টাকা প্রতি কেজি।

ইমাম আহমদ (রহ) এর নিকট সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো।- আল মুগনী ৪/২১৯; আওজাযুল মাসালিক ৬/১২৮।

ইমাম আবু হানীফা (রহ) এর নিকটেও অধিক মূল্যের দ্রব্যের দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরীবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা।

সাহাবায়ে কেরামের যুগে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক ‘সা’ খেজুরের সমপরিমাণ ছিল। নবী কারীম সাল­াল­াহু আলাইহি ওয়া সাল­াম এর যুগে মদীনাতে গমের ফলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীতে হযরত মুআবিয়া (রা) এর যুগে ফলন বৃদ্ধি পেলেও মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। একাধিক বর্ণনায় এসেছে যে, সেকালে আধা ‘সা’ গমের মূল্য এক ‘সা’ খেজুরের সমপরিমাণ ছিল।

হযরত মুআবিয়া (রা) এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ‘সা; গমকে সদকা ফিতরের অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের এক ‘সা’র মতো গণ্য করা হত।- আল ইসতিযকার ৯/৩৫৫।

ইবনুল মুনযির বলেন-

সাহাবীদের যুগে যখন গম সহজলভ্য হল তখন তারা আধা ‘সা’ গমকে এক ‘সা’ যবের সমতুল্য গণ্য করলেন।- ফাতহুল মুলহিম ৩/১৫; আওজাযুল মাসালিক ৬/১৩।

তাহলে বুঝা গেল যে, হযরত মুআবিয়া (রা) এর যুগে গম দ্বারা সদকা ফিতর আদায়ের প্রচলন বেড়েছিল। এর কারণ হল যে, তখন গমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্য মানের খাদ্য। এ সময় হযরত ইবনে ওমর সাহাবাদের অনুকরণে খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করতেন। তখন তাঁকে আবূ মিজলায (রহ) বললেন-

‘আল­াহ তাআলা তো এখন সামর্থ্য দিয়েছেন। আর গম খেজুরের চেয়ে অধিক উত্তম। অর্থাৎ আপনার সামর্থ্য রয়েছে বেশি মূল্যের বস্তু সদকা করার। তবুও কেন খেজুর দ্বারা তা আদায় করছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাহাবাদের অনুকরণে এমন করছি।
যাক, আমাদের কথা ছিল, সাহাবায়ে কিরাম গম দ্বারা এ জন্যই সদকা ফিতর আদায় করতেন যে, এর মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিল। হাদীসে পাঁচ প্রকারের খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে গমের মূল্য সবচেয়ে কম। তাহলে এ যুগে সর্ব শ্রেণীর জন্য এমনকি সম্পদশালীদের জন্যও শুধুই গম বা তার মূল্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করা কী করে সমীচীন হতে পারে?
বড়ই আশ্চর্য! পুরো দেশের সব শ্রেণীর লোক বছর বছর ধরে সর্বনিম্ন মূল্যের হিসাবে ফিতরা আদায় করে আসছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সকলেই ফিতরা দিচ্ছে একই হিসাবে জনপ্রতি ৫৫/৬০ টাকা করে। মনে হয় সকলে ভুলেই গেছে যে, গম হচ্ছে ফিতরার ৫টি দ্রব্যের একটি (যা বর্তমানে সর্বনিম্ন মূল্যের)।

সুতরাং আমরা এদেশের ফিতরা আদায়কারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আহŸান জানাচ্ছি তারা যেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী হাদীসে বর্ণিত দ্রব্যগুলোর মধ্যে তুলনামূলক উচ্চমূল্যের দ্রব্যটির হিসাবে ফিতরা আদায় করেন। পনির, কিসমিস, খেজুর কোনোটির হিসাব যেন বাদ না পড়ে। ধনীশ্রেণীর মুসলিম ভাইদের জন্য পনির বা কিসমিসের হিসাবে ফিতরা আদায় করা কোনো সমস্যাই নয়। যেখানে রমযানে ইফতার পাটির নামে ল ল টাকা ব্যয় করা হয়, ঈদ শপিং করা হয় অঢেল টাকার, সেখানে কয়েক হাজার টাকার ফিতরা তো কোনো হিসাবেই পড়ে না। যদি এমনটি করা হয়, তবে যেমনিভাবে পুরো হাদীসের উপর মুসলমানদের আমল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একটি হারিয়ে যাওয়া সুন্নত যিন্দা করা হবে, তেমনি এ পদ্ধতি দারিদ্রবিমোচনে অনেক অবদান রাখবে। গরীব- দুঃখীগণের মুখেও হাসি ফুটে উঠবে ঈদের পবিত্র দিনে।

আরেকটি আবেদন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দেশের সম্মানিত মুফতীগণ, মাশায়েখ হযরত ও দারুল ইফতাগুলোর কাছে, তারা যেন সদকাতুল ফিতর এর পরিমাণ ঘোষণা দেওয়ার সময় হাদীসে বর্ণিত সকল দ্রব্যের হিসাবেই পৃথক পৃথকভাবে বলে দেন এবং মানুষকে যথাসম্ভব উচ্চমূল্যের ফেতরা আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করেন। আল­াহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন।

বুধবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১১

রমজান থেকে কী পেলাম

রমজান থেকে কী পেলাম

লেখক: মাওলানা লুত্ফর রহমান ইবনে ইউসুফ | বুধ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১

মহাপবিত্র মাহে রমজান, বেহেশতী মেহমান। এ মাসেই অবতীর্ণ হয়েছে মহান আল্লাহ তাআলার নির্দেশনায় মহাগ্রন্থ, মহাপবিত্র আল-কুরআন। যাতে রয়েছে মু’মিন মুসলিমদের আত্মশুদ্ধির জন্য তাকওয়া অর্জন ও ধৈর্য ধারণের পাথেয় হিসেবে মহাকল্যাণময় ‘সিয়াম’ সাধনা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ বিধান। এ বিধান যারা সুষ্ঠুভাবে পালন করেছে তাদের দ্বারাই অর্জিত হয়েছে আত্মশুদ্ধির উপায় হিসেবে তাকওয়া বা আল্লাহ ভীতি এবং ধৈর্যের সোপান। এরাই হচ্ছে মহাভাগ্যবান মহান আল্লাহ তাআলার মুত্তাকী বান্দা। এদের জন্যই মহাপুরস্কার হিসেবে অসীম দয়াময় ও দয়াবান মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন, চিরসুখের, মহা আনন্দের, জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতের কথা ও তাদের আরামের আসবাবপত্রের ও সুখশয্যার বর্ণনা।
মহান আল্লাহ তাআলা বলেন, “নিশ্চয়ই সাফল্যমণ্ডিত সে, যে পবিত্র (যার আত্মা বিশুদ্ধ), (সূরা আলা-০৯) তিনি তার মুত্তাকী বান্দাদের সম্পর্কে আরো বলেন, ‘মুত্তাকীদের জন্য আছে সাফল্য. বাগানসমূহ ও আঙ্গুরসমূহ, সমবয়স্ক উদীপ্ত যৌবনা তরুণী এবং পরিপূর্ণ পানপাত্র।” (সূরা-নাবা-৩১-৩৪)
আরো ইরশাদ হচ্ছে “তোমরা প্রতিযোগিতা কর, স্বীয় প্রতিপালকের নিকট থেকে ক্ষমা এবং জান্নাতের জন্য, যার প্রশস্ততা ‘আসমান ও যমীনের সমান’ যা মুত্তকী বা আল্লাহভীরু বান্দাদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।” প্রকৃত রোজাদাররাই মুত্তাকী হিসেবে ভূষিত। কেননা তারা ঈমান ও সওয়াবের আশায় এ কাজ সম্পন্ন করেছেন। তার মহাপ্রভু মহান আল্লাহর ভয়ে রোজা রেখে সকল পাপ ও পাপকার্য ত্যাগ করে। তাই এর প্রতিদান আল্লাহ নিজ হাতে দেবেন। সুতরাং রোজার প্রকৃত মূল্য মানুষ ধারণা করতে অক্ষম। রোজার বিনিময়ে এরচেয়ে বড় পাওনা আর হতে পারে না যেখানে প্রিয় নবী (স.) ঘোষণা করেছেন, যে লোক রমজান মাসের রোজা রাখবে ঈমান ও সওয়াবের আশায় তার পূর্ববর্তী গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (সহীহ বুখারী, মুসলিম, তিরমিযী, আবু দাউদ, নাসায়ী, ইবনে মাজাহ)
নবী করীম (স.) আরো বলেছেন, এটা ধৈর্যের মাস এবং ধৈর্যের ফল হচ্ছে জান্নাত। (বায়হাকী)
মাহে রমজানের আগমনের ফলে পৃথিবীতে আল্লাহর রহমত অবারিতভাবে বর্ষিত হতে থাকে। যারাই রোজা রেখেছে, এরা সকলেই আল্লাহর রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত বা মুক্তির নহরে অবগাহন করেছে। এরচেয়ে পাওয়া আর কী হতে পারে।
মজুর যেমন সারাদিন কাজ করার পর আপন মালিকের নিকট হতে মজুরি পেয়ে যায়, ঠিক তেমনিভাবে মহান আল্লাহ তাআলা তার খালেছ বান্দা এবং নিখুঁত রোজাদারকে রমজান শেষে নিষ্পাপ করে দেন। এই প্রাপ্তি ও শিক্ষা অনুযায়ী সামনের দিনগুলিতে আমাদের চলতে হবে।

শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজার মাহাত্ম্য

শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজার মাহাত্ম্য

লেখক: মুফতি মুফীযুর রাহমান কাসেমী | বুধ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১

মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই ইবাদতের জন্য। এ মহান সৃষ্টি দ্বারা তার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। তিনি চান বান্দা যেন সর্বদা আমারই ইবাদত করে। আমাকেই তার আপন ভাবে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে মহান প্রভু ইরশাদ করেছেন, এবং আমি জিন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য তৈরি করেছি (আল-কুরআন)।
এই মানবজাতি যেন তাদের বাস্তব জীবনে একে অন্যকে আপন ভেবে একে অন্যের দ্বারা উপকৃত হতে পারে এজন্য দিয়ে দিয়েছেন জীবন বিধান। সামাজিক জীবনে তারা পরস্পরে যেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে সেজন্য কুরআন হাদিসে মানবসেবার অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন:যে ব্যক্তি দুনিয়ার বুকে কোন মুমিন ব্যক্তির পেরেশানী/বিপদাপদ দূর করবে আখেরাতের বুকে আল্লাহ পাক তার পেরেশানী/বিপদাপদ দূর করে দিবেন। আর যে কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটিকে গোপন রাখবে আল্লাহ পাক ইহকাল ও পরকালে তার দোষ-ত্রুটিকে গোপন রাখবেন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের সহযোগিতায় লিপ্ত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাকে তার সহযোগিতা দ্বারা বেষ্টন করে রাখবেন (আল-হাদিস)।
উক্ত হাদিসে রসূল (স.) মানবসেবার ফজিলতকে বর্ণনা করেছেন। আর এ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল মানবসেবা অনেক ফজিলতের কাজ।
অন্য এক হাদিসের মধ্যে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: যারা অন্যের উপর দয়া করে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাদের ওপর দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছো তাদের প্রতি দয়া কর। আকাশের অধিবাসী (মহান প্রভু) তোমাদের ওপর দয়া করবেন। (আল-হাদিস)
উক্ত হাদিসের মধ্যে ঐদিকে ইশারা করা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কারো হূদয়ে সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়া হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি তাকে মুসলমান বলে দাবি করার অধিকার রাখে না। একজন মুমিনের জীবন এই সমস্ত গুণে গুণান্বিত হওয়া উচিত। কেননা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এই জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছেন: এবং আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি। (আল-কুরআন)
আবার অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন: এরা হল চতুষ্পদ প্রাণীর ন্যায়, বরং এরচেয়েও আরো নিকৃষ্ট। (আল-কুরআন) আল্লাহ পাকের ভাষায়ই মানবজাতি সম্মানিত। আবার এরাই তার ভাষায় চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট। তাই তো মানবজাতি আল্লাহর নিকট প্রকৃত সম্মানিত ও প্রিয়পাত্র হবে তখনই যখন তাদের জীবনের প্রতিটি কর্ম হবে একমাত্র তারই জন্য। সুখে-দুঃখে একমাত্র তারই ইবাদত করবে। তাকেই ভালোবাসবে। তারই নৈকট্য লাভের চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত থাকবে। আর নফল রোযার দ্বারা আল্লাহ পাক অতি সহজেই বান্দাকে তার কাছে টেনে নেন। হাদিসে এসেছে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয় তোমাদের প্রভু বলেন! প্রত্যেক নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে নিয়ে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আর রোযা হল (এমন একটি ইবাদত) একমাত্র আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিয়ে থাকি। আর রোযা হল জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ এবং রোযাদার ব্যক্তির মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ পাকের নিকট মেশক আম্বরের সুঘ্রাণের চেয়েও অধিক শ্রেষ্ঠতর (আল- হাদিস)।
অন্য হাদিসে এসেছে:হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন জান্নাতের মধ্যে একটি দরজা রয়েছে, যার নাম হল ‘রাইয়্যান’। একমাত্র রোযাদারদেরকেই সেই দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে। সুতরাং রোযাদারই সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। অতএব, সেথায় যে প্রবেশ করে ফেলবে সে কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না (আল-হাদিস)।
অন্য হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন! রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে— একটি হল যখন সে ইফতার করে। আর অপরটি হল যখন সে তার মহান প্রভুর সাথে সাক্ষাত্ করবে (আল-হাদিস)।
মুসলমান ব্যক্তি যাতে শুধু রমযানের রোযা রেখে থেমে না যায়, বরং সে কি করে সহজেই পূর্ণ বছরটা মহান প্রভুর ভালোবাসার পাত্র হয়ে থাকতে পারে এবং কি করে জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে। কেয়ামতের ভয়াবহ দিবসেও সে কি করে হাসতে পারে। থাকতে পারে আনন্দের সাথে। রাসূল (সা.) উম্মতের সামনে এই পথটি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন।
হাদিস শরীফে এসেছে:হযরত আবু আইয়ূব (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন! যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখল অতঃপর তার সাথে সাথে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখল সে যেন পূর্ণ বছরই রোযা রাখল (আল-হাদিস)। অর্থাত্, একজন ব্যক্তি যখন রমযান মাসের রোযা রেখে তার সাথে সাথে শাওয়াল মাসেও ছয়টি রোযা রাখল সে এই রোযার কারণে আল্লাহ পাকের দরবারে পূর্ণ একটি বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব পেয়ে গেল। একটু ভেবে দেখুন, রমযানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের মধ্যে ছয়টি রোযা রাখার এই আমলটা কতই না সহজ, কিন্তু তার ফজিলত কতই না মহান। কার পক্ষে সহজেই সম্ভব এক বছর লাগাতার রোযা রাখা। অথচ এই আমলটা এই ফজিলত সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তা সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব। শুধু মনের সত্ নিয়তই যথেষ্ট। বান্দা যখন প্রকৃতভাবে আল্লাহকেই ভালোবাসে তখন তার জন্য একদম কঠিন থেকে কঠিনতম আমলও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। বান্দা যখন আল্লাহ পাকের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অগ্রসর হয় আল্লাহ পাকের রহমত তার দিকে দৌড়িয়ে অগ্রসর হয়। বান্দা যখন আল্লাহ পাকের প্রেমে বিভোর হয়ে তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সামান্যতম আমল তার দরবারে পেশ করে আল্লাহ পাক বান্দার এই আমলকে দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ পাকের এই দয়া ও অনুগ্রহ বান্দা তখনই লাভ করবে যখন বান্দা আমল করবে। কেননা আল্লাহ পাকের রহমত লাভের জন্য একটি ওছিলা আবশ্যক। আর তা হল আমল। তাই তো বান্দা যেন আল্লাহ পাকের রহমতকে হাতছাড়া না করে।
অন্য একটি হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে: রসূল (স.)কে সারা বছর রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে তোমার ওপর তোমার পরিবার-পরিজনের হক বা অধিকার রয়েছে। অতঃপর তিনি বললেন, রমযানের এবং তার পরবর্তী দিনগুলোরও প্রত্যেক বুধবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখ। সুতরাং যখন তুমি এই রোযাগুলো রাখবে তখন যেন তুমি সারাটা বছরই রোযা রাখলে।(আল-হাদিস)
এই সমস্ত আরো অনেক হাদিস রয়েছে, যার দ্বারা শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখার ফযীলত প্রমাণিত হয়। সুতরাং আসুন আমরা এই মহান ফজিলত ও বরকতময় আমলটি নিজ জীবনে বাস্তবায়িত করি। তাহলেই সফল হবে আমাদের ইহকাল ও পরকাল। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।

ঈদুলফিতরের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য

ঈদুলফিতরের মাহাত্ম্য ও তাৎপর্য

লেখক: মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী | বুধ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১,


এক মাস সিয়াম সাধনার পর সমগ্র মুসলিম বিশ্বে পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দের হিল্লোল প্রবাহিত হয়। রমজান শেষ হলে ঈদুল ফিতরের রাতটি খুবই মাহাত্মপূর্ণ। যেমন রসূলুল্লাহ (স.) বলেন ঃ যে ব্যক্তি দু’ঈদের নেকীর আশাধারী হয়ে সালাতে দাঁড়াবে তার হূদয় সেদিন মরবে না যেদিন অনেক মানুষ মনমরা হয়ে থাকবে। (ইবনে মাজাহ, তালখীসুল হাবীব ১৪৩ পৃঃ, কানযুল উম্মাল ১৯৮ পৃঃ)
বিখ্যাত তাবেঈ আল্লামা মুজাহিদ (রহ.) বলেন, রমজানের শেষ দশকের রাতের মত ঈদুল ফিতরের রাতও মাহাত্ম্যপূর্ণ এ কারণেই মনে হয় এই প্রসিদ্ধ তাবেঈ (কারো মতে সাহাবী) আবদুর রহমান ইবনে আসওয়াদ বলেন, ঈদুল ফিতরের রাতে অন্যান্যদের মত দুনিয়াবী রং ঢংয়ে রোজা পালনকারীদের মজে থাকা কোন মতেই চলবে না। বরং পারতপক্ষে ঐ রাত নফল ইবাদাতে কাটানো উচিত।
আল্লামা হাফিয ইবনে হাজার আসকালানী (রহ.) বলেন, একথা বর্ণিত আছে যে, রসূলুল্লাহ (স.) সর্বপ্রথম যে ঈদের সালাত পড়েন তা হল দ্বিতীয় হিজরীতে। তারপর থেকে তিনি দুনিয়া ত্যাগ করা পর্যন্ত আজীবন দু’ঈদের সালাত পড়েন। (তালখীসুল হাবীর ১৪২ পৃঃ)
রসূলূল্লাহ (স.) দু’ঈদের দিনে গোসল করতেন। (ইবনে মাজা ৯৪পৃঃ) তারপর তিনি সবচেয়ে সুন্দর কাপড় পরতেন। কখনো তিনি সবুজ রংয়ের চাদর পরতেন। (নাসাঈ ১ম খণ্ড-১৭৮পৃঃ) আবার কখনো লাল ফুলের বুটি দেয়া চাদর পরতেন।(যাদুল মা’আদ ১ম খণ্ড-১২১পৃঃ) জাবির (রা.) বলেন, দু’ঈদে ও জুমআতে নবী (স.)তাঁর লাল বুটি দেয়া বিশেষ চাদরটি পরতেন। (ইবনে খুযায়মা, নায়লুল আওতার ৩য় খণ্ড -১৬৬ পৃঃ) প্রত্যেক ঈদে তিনি এক বিশেষ ইয়েমেনী চাদর পরতেন। (কিতাবুল উম্ম ২০৬ পৃঃ) তারপর তিনি সর্বোত্তম খুশবু লাগাতেন। (হাকিম, ফতহুল আল্লাম ১ম খণ্ড -২২১পৃঃ) তিনি বেজোড় খেজুর খেয়ে ঈদুল ফিতরের জন্য সকালে ঘর থেকে বের হতেন। (বুখারী ১৩০ পৃঃ) এবং ঈদুল আযহার দিনে সালাত না পড়া পর্যন্ত কিছু খেতেন না। (তিরমিযী ১ম খণ্ড-৭১ পৃঃ ইবনে মাজাহ, মিশকাত ১২৬ পৃঃ) আলী (রা.) বলেন, সুন্নাত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। (তিরমিযী ১ম খণ্ড-৬৯পৃঃ বুলুগুল মারাম ৩৫ পৃঃ) তাই তিনি হেঁটে ঈদগাতে যেতেন এবং হেঁটেই বাড়ী ফিরতেন। (ইবনে মাজাহ ৯৩) তিনি এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যেতেন এবং অপর রাস্তা দিয়ে বাড়ী ফিরতেন। (ইবনে খুযায়মা ২য় খন্ড, ৩৪৩ পৃঃ) এবং ঘর থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত তিনি তাকবীর দিতে দিতে যেতেন। (হাকিম, তালখীসুল হাবীর, ১৪২ পৃঃ)
আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, নবী (স.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে ঈদগাহে যেতেন। (বুখারী, ১৩১ পৃঃ, মুসলিম ১ম খণ্ড-২৯০ পৃঃ, মিশকাত ১২৫পৃঃ)
আবূ হুরায়রাহ (রা.) বলেন, একবার বৃষ্টি হওয়ায় নবী (স.) সবাইকে নিয়ে মসজিদে ঈদের সালাত পড়েন। (আবু দাঊদ ১ম খণ্ড-১৬৪ পৃঃ ইবনে মাজাহ ৯৪পৃঃ, মিশকাত ১২৫পৃঃ)
উক্ত দু’টি হাদীস প্রমাণ করে যে, কোন এক মাঠেই ঈদের সালাত পড়া উত্তম ও সুন্নাত। তবে বৃষ্টি হলে এবং মাঠে সালাত পড়া সম্ভব না হলে মসজিদে ঈদের সালাত পড়া যাবে।
ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত নবী (স.) ঈদের দিন দু’ রাকআত সালাত পড়েন। তার আগে এবং পরে কোন সালাতই তিনি পড়েননি। (সিহাহ সিত্তা ও মুসনাদে আহমাদ, বুলুগুল মারাম- ৩৫পৃঃ) একদা ওয়াসিলাহ ঈদের দিনে রসূলূল্লাহ (স.) এর সাথে সাক্ষাত করে বলেন, ‘আল্লাহ আমাদের এবং আপনার তরফ থেকে ঈদকে কবূল করুন। তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ। তাকাব্বালাল্লা-হু মিন্না ওয়া মিনকা। (ইবনে আদী) রসূলুল্লাহ (স.) এর সাহাবীগণ যখন ঈদের দিন সাক্ষাত করতেন তখন একে অপরকে বলতেন তাকাব্বালাল্লা-হু মিন্না ওয়া মিনকা। (ফতহুল বারী ২য় খণ্ড-৪৪৬ পৃঃ) রসূলূল্লাহ (স.) ঈদগাহে যাবার সময় একটা লাঠি বা বল্লম নিয়ে যেতেন এবং সালাত শুরুর আগে সেটা তাঁর সামনে সুতরা হিসেবে ব্যবহার করতেন। (বুখারী ১৩৩ পৃঃ) অতঃপর তিনি আল্লাহু আকবার বলে তাকবীরে তাহরীমা বলে হাত বাঁধতেন। তারপর তিনি সানা পড়তেন। (ইবনে খুযায়মা)
নু’মান বিন বাশীর (রা.) বলেন, রসূলূল্লাহ (স.) দু’ ঈদের ও জুমআতে সূরা সাব্বিহিসমা রব্বিকাল আ’লা (সূরা-আ’লা) ও হাল আতা-কা হাদীসুল গাশিয়াহ (সূরা গাশিয়া) পড়তেন। আর যখনই ঈদ ও জুম’আএক দিনে পড়তেন তখনও তিনি ঐ সূরা দু’টিকে উক্ত দুই সালাতেই পড়তেন। (মুসলিম ১ম খণ্ড ২৮৮পৃঃ)
রসূলূল্লাহ(স.) ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতরের দিনে সূরা কাফ ও সূরা কামার পড়তেন। (মুসলিম ১ম খণ্ড ২৯১পৃঃ, আবূ দাঊদ ১ম খণ্ড ৬২ পৃঃ, শিকাত -৮০পৃঃ)
আবূ সাঈদ খুদরী (র.) বলেন, নবী (স.) ঈদুল ফিতর ও আযহার দিনে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হতেন। অতঃপর প্রথম কাজ সালাত আদয় করতেন। তারপর সালাম ফিরে লোকেদের দিকে মুখ করে দাড়াতেন। তখন সব লোকেরা লাইন দিয়ে বসে থাকতো। অতঃপর তিনি তাঁদেরকে ওয়াজ ও নসীহাত করতেন এবং কোন কাজের নির্দেশ দিতেন। তারপর বাড়ী ফিরতেন। (বুখারী ১৩১পৃঃ মুসলিম ১ম খণ্ড-২৯০ পৃঃ, মিশকাত-১২৫পৃঃ, নাসাঈ ১ম খণ্ড-১৭৯পৃঃ)
ইবনে আব্বাসের (রা.) বর্ণনায় আছে যে, পুরুষদের সামনে নাসিহত করার পর রাসুলুল্লাহ (স.) মেয়েদের নিকটে যেতেন এবং তাদেরকেও ওয়াজ ও নসিহত করতেন এবং দান খয়রাত করার হুকুম দিতেন। তখন মেয়েরা তাদের কানের ও হাতের গহনা খুলে বেলালের মাধ্যমে রসূলূল্লাহ (স.) এর কাছে পাঠাতেন। (বুখারী ১৩১ পৃঃ, মুসলিম ১ম খণ্ড-২৮৯ পৃঃ, মিশকাত ১২৫ পৃঃ)
এ হাদীস প্রমাণ করে যে, পুরুষদের সামনে ঈদের যে নসীহাত হয় তার আওয়াজ যদি নারী মুসল্লীরা শুনতে না পায়, তাহলে ইমামের উচিত পুরুষদের খুত্বা শেষ করে মেয়েদের কাছে গিয়ে কিছু বক্তব্য পেশ করা। ইমাম নবনী (রহ.) বলেন, খতীবের উচিত ঈদুল ফিতরের খুত্বায় শ্রোতাদেরকে ফিতরার নিয়মনকানুন শেখানো এবং ঈদুল আজহার খুত্বায় কুরবানীর বিধান শেখানো। (রওযাতুত তা-লেবীন ২য় খণ্ড, ৭৩ পৃঃ)
মহানবী (স.) এর ঈদের খুত্বাহ দেয়ার সময় ঈদগাহে কোন মিম্বার থাকত না। (বুখঅরী-১৩১ পৃঃ)
তাই তিনি বেলালের কাঁধে হাত রেখে বৃক্ততা করতেন। (মুসলিম ১ম খন্ড-২৮৯পৃঃ) কখনো তীরের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে খুত্বাহ দিতেন। (আবূ দাঊদ ১ম খণ্ড-১৬২পৃঃ) আবার কখনো বল্লমের উপর ভর রেখে খুত্বাহ দিতেন। (মুসনাদে শাফিঈ, মিশকাত ১২৬পৃঃ) খুত্বার ভেতরে তিনি বেশী করে তাকবীরও দিতেন। (ইবনে মাজাহ ৯২পৃঃ)
ঈদের দিনে ‘খাস করে’ মুসাফাহ এবং কোলাকুলি ও আলিঙ্গন করার ব্যপারে কুরআন ও হাদীসে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে কোন কোন হাদীস দারা প্রমাণিত হয় যে, কোন মুসলিম ব্যক্তির সাথে সাক্ষাত হলেই তাকে সালাম করতে হবে। (মুসলিম মিশকাত ১৩৩পৃৃঃ)।
রসূলূল্লাহ (স.) বলেন ঃ যেদিন ঈদুল ফিতরের দিন সেদিন আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের সামনে গর্ব করতে থাকেন। অতঃপর বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ! মজদুরের পুরস্কার কি, যে তার কাজ পুরোপুরি করেছে? তখন ফেরেশতাগণ বলেন, হে আমাদের প্রতিপালক! তার পুরস্কার তাকে পুরোপুরি এর প্রতিদান দেয়া। এবার আল্লাহ বলেন, হে আমার ফেরেশতাগণ! আমার দাস ও দাসীরা তাদের ওপর চাপানো কর্তব্য পালন করেছে। তারপর তারা উচ্চঃস্বরে (তাকবীর) ধ্বনি দিতে দিতে দো’য়ার জন্য (ঈদগাহে) রওয়ানা হয়েছে। আমার সম্মান ও গাম্ভীর্যের কসম! এবং আমার উদারতা ও উচ্চমর্যাদার কসম! আমি তাদের ডাকে অবশ্য সাড়া দেব। অতঃপর তিনি বলেন, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিলাম এবং তোমাদের পাপগুলি পূণ্য দ্বারা বদলে দিলাম। নবী (স.) বলেন, তাই তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরতে থাকে। (বায়হাকীর শুআবুল ঈমান, (মিশকাত ১৮৬-১৮৩ পৃঃ)
আল্লাহ আমাদের সংযম সাধনা কবুল করে ঈদগাহ হতে নিষ্পাপ অবস্থায় ফেরার তাওফীক দান করুন, আমীন।

Relaeted Other Islamic Blog

Other Blog-site: