রাসুল (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী যেভাবে সঞ্চয় করবেন
সম্পদ মানুষের জীবনের অনিবার্য প্রয়োজন। দ্বীনের ওপর চলার জন্য পার্থিব জীবনে অর্থেরও প্রয়োজন আছে। এই প্রয়োজন শুধু আমাদের এখনকার প্রাসঙ্গিকতা নয়; বরং আদিকাল থেকেই মানুষ উপার্জননির্ভর জীবনযাপন করছে।
আত্মমর্যাদার সঙ্গে সামাজিক জীবনযাপনের জন্য অর্থসম্পদকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সৎ ও আদর্শবান মানুষের জন্য কপর্দকশূন্য জীবনযাপন করা ও জীবন-জীবিকার অর্থনৈতিক ভার অন্যের ঘাড়ে চড়ানো বা অন্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়া সমীচীন নয়। সন্তানদের ভিখারিবেশে রেখে যাওয়াও মান-মর্যাদার পরিপন্থী।
ইসলাম মানুষের এই প্রয়োজন ও আত্মমর্যাদাকে উপেক্ষা করেনি। হাদিসের ভাষ্য দেখুন, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বিদায় হজের সময় সেই অসুখে আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে দেখতে এলেন, যে অসুখে আমি মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়াই। আমি তখন বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমার যন্ত্রণার অবস্থা আপনি দেখেছেন। আর আমি একজন সম্পদশালী মানুষ। আমার একমাত্র মেয়ে ছাড়া কোনো ওয়ারিশ নেই। আমি কি আমার দুই-তৃতীয়াংশ সম্পদ দান করে দেব? রাসুল (সা.) বললেন, না। আমি বললাম, তাহলে কি অর্ধেক সম্পদ দান করে দেব? বললেন, না। এক-তৃতীয়াংশ (দান করে দাও); আর এক-তৃতীয়াংশ অনেক। আর তুমি তোমার ওয়ারিশদের অসহায় এবং মানুষের দুয়ারে ভিক্ষা চেয়ে বেড়াচ্ছে— এ অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে ধনী অবস্থায় রেখে যাওয়া ভালো। (মুসলিম, হাদিস : ১৬২৮; বুখারি, হাদিস : ১২৯৫)
হাদিসটিকে আমরা এ বিষয়ে মূলনীতির মর্যাদা দিতে পারি। এ হাদিসের শিক্ষা হলো, সম্পদ সঞ্চয় করা অবৈধ নয়। সন্তানের জন্য সঞ্চয় করে রেখে যাওয়াকে ইসলামও উৎসাহিত করেছে। উদারপ্রাণে সবকিছু বিলিয়ে দেওয়া, যাতে পরক্ষণেই অন্যের কাছে হাত পাততে হয়— তা কাম্য নয়।
রাসুল (সা.)-ও সম্পদ সঞ্চয় করেছেন বলে আমরা দেখতে পাই। উমর (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসে আছে, রাসুল (সা.) বনু নজিরের খেজুর গাছ বিক্রি করে দিতেন, আর পরিবারের জন্য এক বছরের খাদ্য রেখে দিতেন। (বুখারি, হাদিস : ৫৩৫৭)
এ সম্পর্কে আরেকটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। লাকিত ইবনে সাবুরা (রা.) বলেন, আমি বনু মুন্তাফিকের প্রতিনিধি কিংবা প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে রাসুল (সা.)- এর খেদমতে গিয়েছিলাম। যখন রাসুল (সা.) কাছে এলাম তাকে তখন ঘরে পেলাম না। ঘরে পেলাম উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-কে। তিনি আমাদের জন্য গোশত ও ছাতুর মিশ্রণে ‘খাজিরা’ নামক খাবার তৈরির আদেশ দিলেন। সেই খাবার রান্না হলো এবং আমাদের সামনে পাত্রে করে তা পরিবেশিত হলো। তারপর রাসুল (সা.) আগমন করলেন। আর বললেন, তোমরা খাবার কিছু কি পেয়েছ? যা কিছুর আদেশ করা হয়েছে? আমরা বললাম, হ্যাঁ, আল্লাহর রাসুল! আমরা পেয়েছি।
আমরা রাসুল (সা.)-এর দরবারে বসে আছি। এরই মধ্যে রাখাল তার ছাগলগুলো ছাগলশালার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে এলো। আর তার সঙ্গে ছিল একটি ছাগলছানা ম্যাঁ ম্যাঁ করছিল। রাসুল (সা.) রাখালকে ডেকে বললেন, ওহে কী বাচ্চা দিলো? বলল, মেয়ে ছানা। নবীজি (সা.) বললেন, এর জায়গায় আমাদের জন্য একটি ছাগল জবাই করে ফেল। তারপর আমাকে বললেন, তুমি মনে করো না যে— আমরা তোমার জন্য ছাগল জবাই করেছি। আসলে আমাদের ১০০টি ছাগল রয়েছে। আমরা এর সংখ্যা আর বাড়াতে চাই না। তাই আমাদের রাখাল যখন একটি বাচ্চার খবর দেয়, আমরা সেটির জায়গায় একটি ছাগল জবাই করে ফেলি। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১৪২)
হাদিসটির মাধ্যমে জানা গেল, রাসুল (সা.) পরিবারের জীবিকার জন্য ১০০টি ছাগল পালতেন। সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একজন রাখালও নির্দিষ্ট করা ছিল। সেকালের জীবনমানের হিসেবে হয়ত এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। কাজেই আজকের দিনের জীবনমানের বিবেচনায় উপার্জন ও সঞ্চয় করা দোষণীয় কিছু নয়। তবে স্বতঃসিদ্ধ কথা হলো, ইসলাম সম্পদের পাহাড় গড়তে অনুৎসাহিত করেছে। যা কামাই করব তা শুধুই সঞ্চয় করে রেখে দেব আর সম্পদের পাহাড় নির্মাণ করব— এটা ইসলামের দৃষ্টিতে চরম অপছন্দনীয়। কারণ, ইসলামের দৃষ্টিতে দুনিয়ার সঞ্চয়ের চেয়ে আখেরাতের সঞ্চয়টা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইসলাম অকৃপণ হাতে খরচ করতে উৎসাহিত করেছে।
নবী-পরিবারের মহান মুখপাত্র উম্মুল মুমিনিন আয়েশা (রা.)-এর ব্ক্তব্যে পাওয়া যায়, নবী-জীবনের জীবনযাত্রার মান ও জীবিকার রূপ। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, অথচ একই দিনে জায়তুনের তেল দিয়ে পেট ভরে দুইবার রুটি খেয়ে যাননি। (মুসলিম, হাদিস : ২৯৭৪)।
নবীজির ক্ষুধা ও অর্থদৈন্যের কথা ফুটে উঠেছে ওমর ফারুক (রা.)-এর বাণীতে। তিনি বলেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে দেখেছি— ক্ষুধায় বাঁকা হয়ে পুরো দিন পার করে দিচ্ছেন। উদরপূর্ণ করার মতো এক টুকরো খেজুরও তার ঘরে ছিল না।
লেখক : গবেষক, এমিরেটস সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ অ্যান্ড রিসার্চ (ইসিএসএসআর)
ইসলামী অর্থনীতিতে সঞ্চয়
পবিত্র কোরআনুল কারিমে অপচয় ত্যাগের কঠোর নির্দেশ জারি করে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা আহার এবং পান করো, আর অপচয় কোরো না; আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না। ’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ৩২) অর্থোপার্জন, খরচ ও সঞ্চয়ের ব্যাপারেও মধ্যম পন্থার নির্দেশ ইসলামের। মনে রাখতে হবে, সঞ্চয় করতে গিয়ে যেন কৃপণের তালিকায় নাম না উঠে যায়। অনেকে মনে করেন, জন্মদিন, মৃত্যুদিবস, বিবাহবার্ষিকী, ‘ভালোবাসা’ দিবসের মতো বিভিন্ন দিবস-বার্ষিকীতে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে নির্বিচারে ধারদেনা করে হলেও টাকা উড়াতে পারাই ‘উদারতা’। ক্রমবর্ধমান এসব খরচের জোগান দিতে আনুষ্ঠানিকতায় তাল মেলাতে কালো টাকার পেছনে দৌড়ানো, চোরা পথ আবিষ্কার করাও যেন দোষের নয়! পক্ষান্তরে যিনি হালাল-হারাম, পাপ-পুণ্য, প্রয়োজন-অপ্রয়োজন বিবেচনা করে খরচ করেন এবং অপব্যয় ও অপচয় থেকে বিরত থাকেন, তাঁকে মনে করা হয় ‘কৃপণ’। আসলে স্ত্রী, সন্তানসন্ততির ভরণপোষণ, পিতা-মাতার সব চাহিদা পূরণের মতো আল্লাহ নির্দেশিত খাতে খরচ করতে অবহেলা করাই কৃপণতা। তাই হালাল-হারামের বিধিনিষেধ মেনে খরচকে সীমাবদ্ধ করে দিতে হবে। প্রাচুর্যের সময় খরচের উৎসবে মেতে না উঠে হারাম খরচ সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে মিতব্যয়িতার পথ অবলম্বন করে উদ্বৃত্ত অর্থ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা উচিত। যেন পরবর্তী সময়ে নিজের প্রয়োজনে অন্যের কাছে হাত পাতার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি না হতে হয়। পবিত্র কোরআনুল কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি (কৃপণতাবশে) নিজের হাত ঘাড়ের সঙ্গে বেঁধে রেখে একেবারে ব্যয়কুণ্ঠ হয়ো না। আবার (অপব্যয়ী হয়ে) একেবারে মুক্তহস্তও হয়ো না, তাহলে তুমি তিরস্কৃত ও নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে। ’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৯)
সন্তানদের জন্য কিছু সঞ্চয় করাও ইসলামের শিক্ষা। সন্তানদের কারো মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়া নবীজি (সা.) কখনো পছন্দ করেননি। রাসুলে কারিম (সা.) বলেন, ‘তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদের মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের সচ্ছল রেখে যাওয়াই উত্তম। ’ (বুখারি : ১/৪৩৫; মুসলিম : ৩/১২৫১)
ইসলাম সঞ্চয়কে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে, তা আরো স্পষ্ট হয় রাসুলে কারিম (সা.)-এর এক হাদিস থেকে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘উত্তম দান তা-ই, যা নিজ অভাবমুক্ততা রক্ষার সঙ্গে হয়। ’ (বুখারি : ২/১১২) কারণ যদি সমুদয় সম্পত্তি দান করে দেওয়া হয়, তাহলে কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে তা মেটাবে কোত্থেকে?
কৃপণ না হয়ে মিতব্যয়ী হয়ে সঞ্চয় করলে হাজার কোটি টাকার মালিক হতেও ইসলাম বাধা দেবে না। মহান ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ধনী ছিলেন। ইরান, ইরাক, সিরিয়া ও হেজাজজুড়ে বিস্তৃত এলাকায় রেশমি কাপড়ের বিশাল ব্যবসা ছিল তাঁর। তাই তো তিনি রাষ্ট্রীয় হাদিয়া-তোহফার পরোয়া না করে নিজ উপার্জনে জীবিকা নির্বাহ, জ্ঞানের সেবা এবং গরিব শিক্ষার্থীদের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করতেন। সঞ্চিত অর্থ থাকলেই তো অর্থনির্ভর সওয়াবের কাজগুলো করা যাবে। রোজাদারকে ইফতার করানো যাবে। হাদিয়া আদান-প্রদান করা যাবে। শরিক হওয়া যাবে জনকল্যাণমূলক কাজে। অর্থ ব্যয় করে সদকায়ে জারিয়ার অফুরন্ত সাওয়াব হাসিল করা যাবে। আবার উদ্বৃত্ত অর্থ যখন নিসাব পরিমাণ হবে এবং তা বর্ষপূর্তি হবে, তখন জাকাতের মাধ্যমে সে সম্পদের ৪০ ভাগের এক ভাগ গরিবদের মধ্যে দান করে লাভ করবে। অর্থ সঞ্চয় করলেই তো বাইতুল্লাহর পবিত্র চত্বরে প্রেমের মিছিলে শরিক হয়ে হজ ও ওমরার মাধ্যমে গুনাহ মাফ করিয়ে নেওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা যাবে।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফিক মসজিদ
বোর্ড বাজার (আ. গনি রোড), গাজীপুর
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন