শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজার মাহাত্ম্য
লেখক: মুফতি মুফীযুর রাহমান কাসেমী | বুধ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১১
মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তারই ইবাদতের জন্য। এ মহান সৃষ্টি দ্বারা তার আর কোন উদ্দেশ্য নেই। তিনি চান বান্দা যেন সর্বদা আমারই ইবাদত করে। আমাকেই তার আপন ভাবে। এ মর্মে পবিত্র কুরআনে মহান প্রভু ইরশাদ করেছেন, এবং আমি জিন ও মানবজাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য তৈরি করেছি (আল-কুরআন)।
এই মানবজাতি যেন তাদের বাস্তব জীবনে একে অন্যকে আপন ভেবে একে অন্যের দ্বারা উপকৃত হতে পারে এজন্য দিয়ে দিয়েছেন জীবন বিধান। সামাজিক জীবনে তারা পরস্পরে যেন ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে সেজন্য কুরআন হাদিসে মানবসেবার অনেক ফজিলত বর্ণনা করা হয়েছে।
রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন:যে ব্যক্তি দুনিয়ার বুকে কোন মুমিন ব্যক্তির পেরেশানী/বিপদাপদ দূর করবে আখেরাতের বুকে আল্লাহ পাক তার পেরেশানী/বিপদাপদ দূর করে দিবেন। আর যে কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটিকে গোপন রাখবে আল্লাহ পাক ইহকাল ও পরকালে তার দোষ-ত্রুটিকে গোপন রাখবেন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তি তার অপর ভাইয়ের সহযোগিতায় লিপ্ত থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ পাক তাকে তার সহযোগিতা দ্বারা বেষ্টন করে রাখবেন (আল-হাদিস)।
উক্ত হাদিসে রসূল (স.) মানবসেবার ফজিলতকে বর্ণনা করেছেন। আর এ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল মানবসেবা অনেক ফজিলতের কাজ।
অন্য এক হাদিসের মধ্যে রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: যারা অন্যের উপর দয়া করে মহান আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন তাদের ওপর দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছো তাদের প্রতি দয়া কর। আকাশের অধিবাসী (মহান প্রভু) তোমাদের ওপর দয়া করবেন। (আল-হাদিস)
উক্ত হাদিসের মধ্যে ঐদিকে ইশারা করা হয়েছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত কারো হূদয়ে সৃষ্ট জীবের প্রতি দয়া হবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত সে ব্যক্তি তাকে মুসলমান বলে দাবি করার অধিকার রাখে না। একজন মুমিনের জীবন এই সমস্ত গুণে গুণান্বিত হওয়া উচিত। কেননা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ পাক এই জাতিকে লক্ষ্য করে বলেছেন: এবং আমি বনী আদমকে সম্মানিত করেছি। (আল-কুরআন)
আবার অন্যত্র আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন: এরা হল চতুষ্পদ প্রাণীর ন্যায়, বরং এরচেয়েও আরো নিকৃষ্ট। (আল-কুরআন) আল্লাহ পাকের ভাষায়ই মানবজাতি সম্মানিত। আবার এরাই তার ভাষায় চতুষ্পদ প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট। তাই তো মানবজাতি আল্লাহর নিকট প্রকৃত সম্মানিত ও প্রিয়পাত্র হবে তখনই যখন তাদের জীবনের প্রতিটি কর্ম হবে একমাত্র তারই জন্য। সুখে-দুঃখে একমাত্র তারই ইবাদত করবে। তাকেই ভালোবাসবে। তারই নৈকট্য লাভের চেষ্টায় সর্বদা ব্যস্ত থাকবে। আর নফল রোযার দ্বারা আল্লাহ পাক অতি সহজেই বান্দাকে তার কাছে টেনে নেন। হাদিসে এসেছে হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন: নিশ্চয় তোমাদের প্রভু বলেন! প্রত্যেক নেক আমলের প্রতিদান দশ থেকে নিয়ে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি হয়ে থাকে। আর রোযা হল (এমন একটি ইবাদত) একমাত্র আমারই জন্য এবং আমি নিজেই এর প্রতিদান দিয়ে থাকি। আর রোযা হল জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য ঢালস্বরূপ এবং রোযাদার ব্যক্তির মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ পাকের নিকট মেশক আম্বরের সুঘ্রাণের চেয়েও অধিক শ্রেষ্ঠতর (আল- হাদিস)।
অন্য হাদিসে এসেছে:হযরত সাহল ইবনে সা’দ (রা.) সূত্রে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূল (সা.) ইরশাদ করেছেন জান্নাতের মধ্যে একটি দরজা রয়েছে, যার নাম হল ‘রাইয়্যান’। একমাত্র রোযাদারদেরকেই সেই দরজা দিয়ে আহ্বান করা হবে। সুতরাং রোযাদারই সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে। অতএব, সেথায় যে প্রবেশ করে ফেলবে সে কখনো তৃষ্ণার্ত হবে না (আল-হাদিস)।
অন্য হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে: হযরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন! রোযাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে— একটি হল যখন সে ইফতার করে। আর অপরটি হল যখন সে তার মহান প্রভুর সাথে সাক্ষাত্ করবে (আল-হাদিস)।
মুসলমান ব্যক্তি যাতে শুধু রমযানের রোযা রেখে থেমে না যায়, বরং সে কি করে সহজেই পূর্ণ বছরটা মহান প্রভুর ভালোবাসার পাত্র হয়ে থাকতে পারে এবং কি করে জান্নাতের স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে। কেয়ামতের ভয়াবহ দিবসেও সে কি করে হাসতে পারে। থাকতে পারে আনন্দের সাথে। রাসূল (সা.) উম্মতের সামনে এই পথটি স্পষ্ট করে দিয়ে গেছেন।
হাদিস শরীফে এসেছে:হযরত আবু আইয়ূব (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন! যে ব্যক্তি রমযানের রোযা রাখল অতঃপর তার সাথে সাথে শাওয়াল মাসের ছয়টি রোযা রাখল সে যেন পূর্ণ বছরই রোযা রাখল (আল-হাদিস)। অর্থাত্, একজন ব্যক্তি যখন রমযান মাসের রোযা রেখে তার সাথে সাথে শাওয়াল মাসেও ছয়টি রোযা রাখল সে এই রোযার কারণে আল্লাহ পাকের দরবারে পূর্ণ একটি বছর রোযা রাখার সমান সওয়াব পেয়ে গেল। একটু ভেবে দেখুন, রমযানের পরবর্তী মাস শাওয়ালের মধ্যে ছয়টি রোযা রাখার এই আমলটা কতই না সহজ, কিন্তু তার ফজিলত কতই না মহান। কার পক্ষে সহজেই সম্ভব এক বছর লাগাতার রোযা রাখা। অথচ এই আমলটা এই ফজিলত সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও তা সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব। শুধু মনের সত্ নিয়তই যথেষ্ট। বান্দা যখন প্রকৃতভাবে আল্লাহকেই ভালোবাসে তখন তার জন্য একদম কঠিন থেকে কঠিনতম আমলও সহজ হয়ে দাঁড়ায়। বান্দা যখন আল্লাহ পাকের দিকে হাঁটি হাঁটি পা পা করে অগ্রসর হয় আল্লাহ পাকের রহমত তার দিকে দৌড়িয়ে অগ্রসর হয়। বান্দা যখন আল্লাহ পাকের প্রেমে বিভোর হয়ে তার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সামান্যতম আমল তার দরবারে পেশ করে আল্লাহ পাক বান্দার এই আমলকে দশ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেন। আর আল্লাহ পাকের এই দয়া ও অনুগ্রহ বান্দা তখনই লাভ করবে যখন বান্দা আমল করবে। কেননা আল্লাহ পাকের রহমত লাভের জন্য একটি ওছিলা আবশ্যক। আর তা হল আমল। তাই তো বান্দা যেন আল্লাহ পাকের রহমতকে হাতছাড়া না করে।
অন্য একটি হাদিসে ইরশাদ হচ্ছে: রসূল (স.)কে সারা বছর রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে তোমার ওপর তোমার পরিবার-পরিজনের হক বা অধিকার রয়েছে। অতঃপর তিনি বললেন, রমযানের এবং তার পরবর্তী দিনগুলোরও প্রত্যেক বুধবার ও বৃহস্পতিবারে রোযা রাখ। সুতরাং যখন তুমি এই রোযাগুলো রাখবে তখন যেন তুমি সারাটা বছরই রোযা রাখলে।(আল-হাদিস)
এই সমস্ত আরো অনেক হাদিস রয়েছে, যার দ্বারা শাওয়ালের ছয়টি রোযা রাখার ফযীলত প্রমাণিত হয়। সুতরাং আসুন আমরা এই মহান ফজিলত ও বরকতময় আমলটি নিজ জীবনে বাস্তবায়িত করি। তাহলেই সফল হবে আমাদের ইহকাল ও পরকাল। আল্লাহ পাক আমাদেরকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন