ডায়াবেটিস ও রোজা-ডা. আহসানুল হক আমিন
সারা বিশ্বে টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মুসলমানদের ৮০ শতাংশ এবং টাইপ ওয়ানের প্রায় ৪৫ শতাংশ সিয়াম সাধনা করে থাকে। কিন্তু এর আগে ডায়াবেটিক রোগীদের রোজা রাখার বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল না। বিগত বছরগুলোতে মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক গবেষণার মাধ্যমে কিছু নিয়ম নির্ধারণ করা হয়েছে, যেগুলো অনুসরণ করে ডায়াবেটিক রোগীরা সিয়াম পালনরত অবস্থায় জটিলতা এড়িয়ে চলতে পারেন।
রমজানে দীর্ঘ সময় অভুক্ত অবস্থার পরপরই ১০ ঘণ্টার মধ্যে তিনবার খাদ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয়। ইফতারের তিন-চার ঘণ্টা পর রাতের খাবার, অতঃপর সূর্যোদয়ের আগে সেহরি, তদুপরি এর সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবর্তিত খাদ্য উপাদান। বিশেষত প্রচলিত ইফতারে মুখরোচক মিষ্টি, তৈলাক্ত, শর্করাসমৃদ্ধ খাদ্যের আধিক্য থাকে। দীর্ঘস্থায়ী তারাবির নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত, ঈদুল ফিতরের প্রস্তুতি, গ্রামের বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কারণে জীবনযাত্রার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ফলে শরীরে গ্লুকোজ, ইনসুলিন ও চর্বির উল্লেখযোগ্য তারতম্য দেখা দেয়।
ডায়াবেটিক রোগীর জন্য রোজা রাখা নিষিদ্ধ নয়, অসম্ভবও নয়। রমজান শুরু হওয়ার আগে থেকে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়ে সহজ ও নিরাপদ উপায়ে রোজা পালন করা যায়। যেসব রোগী শুধু ব্যায়াম ও খাদ্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেন এবং যাঁরা সেনসিটাইজার-জাতীয় ওষুধ (মেটফরমিন ও গি্লটাজন) ব্যবহার করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা কম। অন্যদিকে সালফোনাইল ইউরিয়া ও ইনসুলিন ব্যবহারকারীরা জটিলতার সম্মুখীন হতে পারেন।
জটিলতা ও প্রতিকার
হাইপোগ্লাইসেমিয়া
দীর্ঘ সময় অভুক্ত থাকা, অতিরিক্ত ও অপরিকল্পিত শারীরিক পরিশ্রম এবং ভুল মাত্রার ওষুধ গ্রহণ শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমিয়ে দিতে পারে। এর লক্ষণগুলো হচ্ছে_অস্থির বোধ করা, অতিরিক্ত ঘাম, বুক ধড়ফড়, চোখে ঝাপসা দেখা, অত্যধিক ক্ষুধা, অস্বাভাবিক আচরণ ইত্যাদি। এ লক্ষণগুলো দেখা গেলে অথবা রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৩ দশমিক ৫ মিলিমোল/লিটারের নিচে কমে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে রোজা ভেঙে ফেলতে হবে।
এক গ্লাস পানিতে চার থেকে ছয় চামচ চিনি গুলিয়ে খাওয়ানো উত্তম। এর অনুপস্থিতিতে যেকোনো ধরনের খাবার (প্রধানত শর্করা ও চিনিসমৃদ্ধ) দেওয়া যেতে পারে। অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে মুখে খাবার না দিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রের সহায়তায় শিরায় গ্লুকোজ প্রয়োগ করা জরুরি। এ কারণে সিয়াম পালনরত অবস্থায় চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্লুকোমিটারের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নির্ধারণ করে সঠিক মাত্রার ইনসুলিন অথবা মুখে খাওয়ার ওষুধ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়।
হাইপারগ্লাইসেমিয়া
রমজানে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা কয়েক গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। অপরিকল্পিতভাবে ইনসুলিনের মাত্রা হ্রাস এবং শর্করাজাতীয় খাদ্যের আধিক্য এর কারণ। এর লক্ষণগুলো হলো বমিভাব, মাথা ঘোরা, পানির পিপাসা, দুর্বলতা ইত্যাদি। রক্তে কিটোনবডির মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে কিটোএসিডোসিসের মতো জীবন সংশয়কারী অবস্থা তৈরি হয়। কাজেই লক্ষণগুলো প্রকাশ পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে গ্লুকোমিটার ও রক্ত পরীক্ষা, ইনসুলিন গ্রহণ এবং দ্রুত হাসপাতালে যোগাযোগ করতে হবে।
রোজা পালন যাঁদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ
* পূর্ববর্তী তিন মাসের মধ্যে মারাত্দক হাইপোগ্লাইসেমিয়া অথবা কিটোএসিডোসিস আক্রান্ত রোগী, যাঁদের ব্লাড সুগার ব্যাপকভাবে ওঠানামা করে।
* ডায়াবেটিসের সঙ্গে যাঁরা অন্যান্য জটিলতায় ভুগছেন (যেমন_হার্টের সমস্যা, স্ট্রোক, স্নায়ুরোগ ইত্যাদি)।
* অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস।
* যারা বারবার গ্লুকোজস্বল্পতায় (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) ভোগেন।
* কিডনি বৈকল্যজনিত অবস্থা, বিশেষত যাঁরা ডায়ালাইসিস গ্রহণ করেন।
* গর্ভাবস্থা।
* বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি, বিশেষত যাঁরা একাকী বাস করেন।
রমজান শুরু হওয়ার আগে জেনে নিন
* খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রিত রোগীদের খাদ্য ও তরল খাবার সম্পর্কে ডাক্তারের কাছ থেকে চার্ট করে নিন।
* মুখে গ্রহণকৃত ওষুধের ধরন ও মাত্রা পরিবর্তন করতে হবে কি না। সাধারণত সকালের ডোজ সামান্য কম মাত্রায় ইফতারের সময় এবং রাতের ডোজ অর্ধেক মাত্রায় সেহরির সময় খেতে বলা হয়।
* ইনসুলিনের ক্ষেত্রে সকালের ডোজ ইফতারের সময় এবং রাতের ডোজ কিছুটা কম পরিমাণে সেহরির সময় নিতে হয়।
* সম্ভব হলে আধুনিক, দীর্ঘস্থায়ী ইনসুলিন (গ্লারজিন ও ডেটেমির) এবং যেসব মুখে খাওয়ার ওষুধ রমজানে বিশেষ উপযোগী (গি্লক্লাজাইড এমআর, গি্লমেপেরাইড) সেগুলোর ব্যবহার করা দরকার।
* দিনের বেলায় ব্যায়াম পরিত্যাগ করে ইফতার অথবা রাতের খাবারের পর আধা ঘণ্টা ব্যায়াম করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, তারাবির নামাজে পর্যাপ্ত ব্যায়াম হয়ে থাকে।
রমজান মাসে ডায়াবেটিক রোগীর খাবার
* রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করা হতো, তা বজায় রেখে খাবারের ধরন ও সময় বদলাতে হবে। প্রয়োজনে পুষ্টিবিদ অথবা ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা বাঞ্ছনীয়।
* ইফতারে অতিরিক্ত মিষ্টি ও তৈলাক্ত খাবার খাবেন না।
* সেহরি যত বিলম্বে গ্রহণ করা যায় ততই ভালো।
* পর্যাপ্ত পানি ও তরল, ফল, শাকসবজি, ডাল গ্রহণ করতে হবে। ডাবের পানি, সুইটনার ব্যবহৃত শরবত ইফতারের জন্য উপযোগী। তেলে ভাজা খাদ্য (পেঁয়াজু, বেগুনি, পুরি, পরোটা) অল্প পরিমাণে গ্রহণ করা ভালো।
* ইফতারে অধিক ভোজন ও সেহরিতে স্বল্প আহার পরিত্যাগ করুন।
রক্ত পরীক্ষা ও ইনসুলিন গ্রহণ
* রোজা পালনরত অবস্থায় রক্তের গ্লুকোজ মাপা ও চামড়ার নিচে ইনসুলিন গ্রহণ করা জায়েজ বলে দেশের ও মুসলিম বিশ্বের আলেমরা মত দিয়েছেন।
* সেহরির দুই ঘণ্টা পর এবং ইফতারের এক ঘণ্টা আগে গ্লুকোজ পরীক্ষা করে ওষুধের মাত্রা ঠিক করতে হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র সুশৃঙ্খল জীবনপদ্ধতি। সঠিক নির্দেশনা অনুযায়ী সিয়াম সাধনা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি উত্তম সুযোগ। এতে রক্তে গ্লুকোজ ও চর্বির পরিমাণ হ্রাস পায় এবং ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা যায়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক এবং ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ
বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল
গ্রন্থনা : হুমায়রা ফেরদৌস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন